মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
গুলশানে আগুন

ভবনের ১০ ও ১১ তলার সব ছাই

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভবনের ১০ ও ১১ তলার সব ছাই

গুলশানে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত আবাসিক ভবন

রাজধানীর গুলশানে অগ্নিকাণ্ডে সেই ভবনের ১০ ও ১১ তলার সবকিছু পুড়ে গেছে। আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে গতকাল সকাল থেকে কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবনের চার তলার লিফটের পাশে বৈদ্যুতিক তার থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। চার তলায় হার্ড বোর্ড দিয়ে আবদ্ধ ছিল লিফট চলাচলের জন্য বৈদ্যুতিক তার। এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহতদের চিকিৎসার জন্য ১৮ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহতদের চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন।

পুড়ে যাওয়া ভবনটি গতকাল ঘুরে দেখেন প্রকৌশলী মাহফুজুল হাসান। তিনি ভবন নির্মাণের সময় প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম বেজেছে। সেটা শুনে যারা নিচের দিকে ছিলেন, তারা নেমেছেন। আগুন লাগার পর প্রত্যেকেই সিঁড়ি দিয়ে নিরাপদে বের হয়ে যেতে পারতেন। অনেক সময় ভুল অ্যালার্ম হয়। যারা বাসায় ছিলেন, তারা মনে করেছিলেন ভুল অ্যালার্ম হয়েছে। যখন তারা দেখেছেন আগুন এবং নিচ থেকে লোকজন বলছিল আগুন লেগেছে, সবাই নেমে যান, তখন যারা পেরেছেন, নেমে এসেছেন। অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য সব ব্যবস্থাই ছিল। ভবনে অগ্নিনির্বাপন প্রশিক্ষণের একটি টিমও ছিল, তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও নিয়েছে। প্রত্যেক বাসায় সচেতন করেছে। পুরো ভবনটিতেই কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। প্রতি বাসায় সেখান থেকে সংযোগ নেওয়া হয়েছিল। যখনই একটি বাসা থেকে প্রথমে ধোঁয়া যায়, আগুন কিন্তু যায়নি। ধোঁয়ার জন্যই বেশি সমস্যা হয়েছে। আর আগুন ওপরে দুই দিক থেকে বেশি হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিউ এজ গার্মেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরিফ ইব্রাহিমের ১০ ও ১১ তালা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমি সব ফ্লোরে গিয়েছি, তবে অন্যান্য ফ্লোরে মূল দরজা বন্ধ আছে।

রবিবার সন্ধ্যায় গুলশান-২ নম্বরের ১০৪ নম্বর সড়কের ২ নম্বর ১৪ তলা ভবনের ১০ তলায় আগুন লাগে। একপর্যায়ে আগুন ভবনের ১১ তলায় ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের প্রায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ১১টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। শিশু ও নারীসহ ২২ জনকে জীবিত উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। রাতেই ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত দল গঠন করা হয়।

এ ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত দুজনের মৃত্যু হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের সময় তারা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যান বলে জানিয়েছে পুলিশ।

গতকাল দুপুর পৌনে ১২টায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আ. আহাদ সাংবাদিকদের জানান, ভবনের নকশা, আগুনের কারণসহ অন্যান্য কোনো ত্রুটি ছিল কি-না তা খতিয়ে দেখবে ফায়ার সার্ভিস ও রাজউক। তবে আমরা প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে জানতে পেরেছি আগুনের সূত্রপাত ঘটেছিল বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণে। অগ্নিকাণ্ডে রবিবার আনোয়ার নামের একজন এবং গতকাল ভোর ৪টায় রাজু নামে আরেকজন মারা গেছেন। আরও দুজন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন এবং তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অগ্নিকাণ্ডে এখনো কোনো মামলা হয়নি। তিনি বলেন, আমরা ভিতরে প্রবেশ করছি না। তবে ফ্ল্যাটের মালিক যারা রয়েছেন তারা ভবনের নিরাপত্তা কর্মীদের ডেকে নিয়ে প্রবেশ করছেন। ভিতরে কী অবস্থা তা ফ্ল্যাট মালিকরাই বলতে পারবেন। ভবনটি এখন মালিকদের জিম্মায় রয়েছে। আমরা নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছি।

রবিবার রাতে আহত নারীসহ তিনজনকে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। গতকাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রায়হানা আউয়াল জানান, আহতদের চিকিৎসার জন্য ১৮ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তিনি নিজেই এ মেডিকেল বোর্ডের প্রধান। এ বোর্ডে বার্ন বিশেষজ্ঞরা ছাড়াও ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে নিউরো সার্জারি, অর্থোপেডিক, জেনারেল সার্জারি ও থোরাসিক সার্জারির চিকিৎসকও আছেন।

বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী ফোনে আহতদের চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছেন। গুলশানে আগুনের ঘটনায় তিনজন রোগীর মধ্যে সামা রহমানের বিষয়ে কনসার্ন বেশি। তার কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টা পর তার বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। তবে তাকে শঙ্কামুক্ত বলা যাবে না। এ ছাড়া বাকি দুজনের শারীরিক অবস্থা ভালো। দুপুরে তারা ছাড়পত্র পান। এরা হলেন মোছা সিকদার (৩৩) ও রওশন আলী (৩৫)।

জানা গেছে, আগুনের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন মোছা সিকদার ও রওশন আলী। আগুন লাগার সময় ভবনের ১০ তলায় ছিলেন রওশন আলী। তিনি ১০ তলার একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দার বাসায় দাফতরিক কাজে গিয়েছিলেন। মোছা সিকদার ওই ফ্ল্যাটের গাড়িচালক। একই ঘটনায় সামা রহমান সিনহা (৩৮) ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। তিনি আগুন থেকে বাঁচতে সাততলা থেকে সুইমিংপুলে লাফিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হন।

গতকাল সকালে ভবনে লাগা আগুনের কারণ অনুসন্ধানে কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রধান পরিচালক (অপারেশন্স ও মেইনটেনেন্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। গতকাল দুপুরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ওই ভবনের চার তলায় লিফটের পাশে হার্ড বোর্ড দিয়ে তৈরি একটি ইলেকট্রিক বোর্ড ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, সেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত। আগুনে পাঁচ ও ছয় তলায় তেমন ক্ষতি না করে উঠে যায় সাততলায়। তারপর উপরের দিকে ১০, ১১, ১২ তলায়। দুপুরে অগ্নিকাণ্ডের শিকার ভবনটি পরিদর্শনে আসেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আগুন যে কোনো সময়ই লাগতে পারে। ভবনটি সব নিয়ম মেনেই করা হয়েছে। এত সুন্দর ভবন, অথচ আগুন লাগল। জরুরি পরিস্থিতির জন্য ফায়ার ড্রিল করার মতো গার্ড ও বাসিন্দারা প্রশিক্ষিত ছিল কি না, তা জানা নেই। সাধারণত থাকে না। আমরা ফ্যাক্টরিতে বা গার্মেন্টে প্রতিনিয়ত অগ্নিমহড়া করছি, সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করছি। কিন্তু বাসাবাড়িতে সাধারণত সেটা হয় না। ফ্ল্যাট কেনেন কিংবা নিজে বাড়ি করেন, সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর