শিরোনাম
সোমবার, ৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা
কাঁপল সায়েন্সল্যাব মোড় এলাকা ♦ নিহত ৩ আহত ১৭

ভয়াবহ বিস্ফোরণ এবার ঢাকায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভয়াবহ বিস্ফোরণ এবার ঢাকায়

রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়ে গতকাল বিস্ফোরণের পর সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল -রোহেত রাজীব

রবিবার সকাল ১০টা ৫০ মিনিট। হঠাৎ বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরির আশপাশের এলাকা। মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ের প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের পার্শ্ববর্তী বাণিজ্যিক ভবন শিরিন ম্যানশনের দুটো ফ্লোর। প্রলয়ঙ্করী এই বিস্ফোরণে আহত অন্তত ২০ জনের তিনজনকে গুরুতর অবস্থায় স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। বাকি ১৭ জনের মধ্যে ৮ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নিহতরা হলেন- শফিকুজ্জামান (৪৫), আবদুল মান্নান (৬৫) ও তুষার (৩৫)। কীভাবে এ বিস্ফোরণ ঘটেছে সে সম্পর্কে গতকাল রাত পর্যন্ত নিশ্চিত কোনো তথ্য দিতে পারেনি সরকারি সংস্থাগুলো। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন, ঘটনাস্থলে বিস্ফোরক জাতীয় কোনো কিছুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় থেকে নিউমার্কেটের দিকে যেতে ২০০ গজের মধ্যেই শিরিন ম্যানশনের অবস্থান। ঘটনার পরপরই সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, অসংখ্য উৎসুক মানুষ ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছেন। ওই মার্কেটের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন এমন অনেককেই খুঁজছেন তাদের স্বজনরা। ৩৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের জরাজীর্ণ এই তিন তলা ভবন। সকাল পৌনে ১১টার দিকে সেখানে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এরই মধ্যে সেখানে উপস্থিত হন ফায়ার সার্ভিস, কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বোম্ব ডিসপোজাল টিম, সিটি করপোরেশনের রেসকিউ ইউনিটের সদস্যরা। গ্যাস লাইন পরীক্ষা করে দেখছেন তিতাসের একটি দল। নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ শুরুর দিকে ঘটনাস্থল সংলগ্ন মিরপুর সড়কের দুই পাশ পরবর্তীতে এক পাশ আটকে রাখে বেশ কিছুক্ষণ। এতে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা স্থানীয় ব্যবসায়ী রাসেল আহমদ বলেন, ভবনটির নিচ তলায় ৮টি ও দ্বিতীয় তলায় ৬টি পাঞ্জাবির দোকান আছে। নিচ তলায় রয়েছে হোটেল প্যারাডাইজ নামের একটি খাবারের দোকান। দ্বিতীয় তলায় সেলুন, টেইলারসহ দোকান আছে আরও দুটি। তৃতীয় তলায় পুরোটায়ই রয়েছে ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের অফিস। এ অফিস থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বিস্ফোরণের পরপরই ভবনের তিন তলায় আগুন ধরে যায়। কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় পুরো এলাকা। তিন দফায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর পুরো এলাকার বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় কর্তৃপক্ষ।

বিস্ফোরণের প্রত্যক্ষদর্শী ভবনটির নিচ তলার মেহেদী পাঞ্জাবি দোকানের ম্যানেজার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, প্রতিদিনের মতো তিনি যথারীতি সকাল সোয়া ১০টা দিকে দোকান খুলতে মার্কেটে আসেন। দোকানের চাবি থাকে পাশেই বসবাস করা এক কর্মচারীর কাছে। কর্মচারীর আসতে দেরি দেখে তিনি ভবনের উত্তর দিকে প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সকাল পৌনে ১১টার দিকে বিকট শব্দে ভবনটির তিন তলায় বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে তিন তলা থেকে ইট পাথর, সিমেন্ট, পলেস্তারা, মোটা ইটের দেয়াল, কাচের দরজা, জানালা, এসি, শাটারসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র বিদ্যুৎ বেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

ঘটনাস্থলের পাশেই রাস্তার ওপর ফেরি করে চানাচুর বিক্রেতা আবুল কালাম আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, ঘটনার সময় রাস্তায় লোকজনের স্বাভাবিক চলাচল ছিল। হঠাৎ বিস্ফোরণে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়। মানুষের মধ্যে রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ নিরাপদ জায়গা খুঁজতে দৌড়াতে থাকে। মুহূর্তেই রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিস্ফোরণের সময় ভবনটির পশ্চিম দিকের মিরপুর সড়কে থাকা একজন, নিচে দাঁড়িয়ে থাকা একজন এবং মাথায় ইট পড়ে আরেক জনসহ মোট তিন জন ঘটনাস্থলেই মারা যান।  

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডিউটি অফিসার রাশেদ বিন খালিদ জানান, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে হাজির হয়। তারা প্রায় সোয়া ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। বিস্ফোরণের কারণ জানতে ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা রয়েছে। তবে সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো কমিটি গঠিত হয়নি। তৃতীয় তলার এসি থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটে আচমকা বিদ্যুতের চাপ বেশি আসায় এবং এসিগুলো সার্ভিসিং না করার কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বেলা ৩টার দিকে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকসহ ঊর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। পরিদর্শন শেষে ডিএমপি কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাস্থলে কোনো ধরনের বিস্ফোরকের আলামত পাওয়া যায়নি। ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা বলে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে। তারপরেও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন সেনাবাহিনীর একটি বিশেষজ্ঞ দল। পরে বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান কমান্ডিং অফিসার মেজর মো. কায়সার বারী সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরক শনাক্তকরণ যন্ত্র দিয়ে ঘটনাস্থলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। পর্যবেক্ষণে বিস্ফোরণের ঘটনাটি বিস্ফোরক দ্রব্যের কারণে হয়নি বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহৃত হলে সেটি আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া যেত। বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ আরও তদন্ত শেষে জানা যাবে।

তবে এর আগে সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) রহমত উল্লাহ বলেছিলেন, স্যুয়ারেজ লাইনে জমে থাকা গ্যাস থেকে ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছে। ভবনটিতে কোনো না কোনোভাবে গ্যাস জমে ছিল। জমে থাকা গ্যাসের ঘনমাত্রা ৫-১১ হলে, এরপর তাতে কোনোভাবে যদি ট্রিগার হয়, তবে এ ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। এই ট্রিগার যে কোনো ইলেকট্রিক সুইচ, ফ্যানের সুইচ ও এসির সুইচের মাধ্যমেও হতে পারে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, এটি গ্যাস থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণ। আর এত বড় বিস্ফোরণ গ্যাস থেকেই সৃষ্টি হয়ে থাকে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে সায়েন্সল্যাবের বিস্ফোরণের ঘটনাটি ২০২১ সালে ঘটে যাওয়া মগবাজারের বিস্ফোরণের মতো গ্যাস থেকে সৃষ্ট একটি বিস্ফোরণ। এ জন্য নগরবাসীকে সচেতন থাকতে হবে বৈদ্যুতিক সুইচ ও গ্যাসের চুলা জ্বালানোর আগে। প্রথমে দরজা-জানালা খুলে নিতে হবে, যাতে কক্ষ থেকে গ্যাস বের হয়ে যেতে পারে।

সন্ধ্যা ৬টার দিকে নিউমার্কেট থানার ওসি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, বিকাল ৫টা নাগাদ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পুরো এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করতে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বাড়ির মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। বিস্ফোরণে নিহতের ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে। বিস্ফোরণের কারণে মিরপুর সড়কে প্রায় ২ ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হয়েছে।

মৃতদের পরিচয় : দুর্ঘটনায় নিউ জেনারেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের তিনজন কর্মী মারা গেছেন। মৃত শফিকুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। তিনি নিউ জেনারেশনের কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আবদুল মান্নান রাজধানীর লালবাগের বাসিন্দা। তিনি একই প্রতিষ্ঠানে পিয়ন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আর তুষারের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে। তিনিও সেখানে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আহত হয়ে ঢামেকে চিকিৎসাধীন নিউ জেনারেশন নামে ওই প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্কশপ ইঞ্জিনিয়ার খাইরুল ইসলাম বলেন, হেমায়েতপুরের ফ্যাক্টরি থেকে অফিসে এসেছিলাম একটা কাজে। তারপর হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। চোখের সামনেই তিনজন মারা গেছেন।

বিস্ফোরণের ঘটনায় ভারী কিছু পড়ে গুরুতর আহত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র নূর নবী। তার মাথা ফেটে যায় এবং ডান পা ভেঙে যায়। নূর নবী থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে।

আহতদের বিষয়ে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, বার্ন ইউনিটে পাঁচজন চিকিৎসাধীন। তাদের কাউকেই আইসিইউতে রাখার প্রয়োজন হয়নি। এদের সবাই ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত দগ্ধ হয়েছেন। তাদের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত বলা যাচ্ছে না। তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।

দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা গেছে, ভবনটির মালিক শিরিন আক্তার। তিনি উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষক। বর্তমানে তিনি বিদেশে আছেন বলে জানা গেছে। ভবনটির দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন রতন নামের একজন। তিনি ভবন মালিক শিরিন আক্তারের সম্পত্তির তদারকি করেন। বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় রতনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি ফোনে কিছু শুনতে পারছি না। এরপর দফায় দফায় যোগাযোগ করেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যু হয়।

সর্বশেষ খবর