বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা মাঠে গোয়েন্দারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর সিদ্দিকবাজারের কুইন স্যানিটারি মার্কেটের ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনাটি নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা তা খতিয়ে দেখতে মাঠে গোয়েন্দারা। দুর্ঘটনা হলে কেন এবং কীভাবে এসব দুর্ঘটনা রোধ করা যায় এসব বিষয় নিয়েও প্রতিবেদন আকারে সরকারের উচ্চপর্যায়ে মতামত দেবে সংস্থাগুলো। আবার নাশকতা হলে, কারা এর সঙ্গে জড়িত সেসব বিস্তারিত খুঁজে বের করার প্রস্তুতি নিয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে গোয়েন্দারা। তারা প্রতিটি সন্দেহের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে মতামত নিচ্ছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে কুইন স্যানিটারি মার্কেটের ঘটনাটি প্রকৃত দুর্ঘটনা নাকি অন্তর্ঘাতমূলক কিছু এর সঠিক তদন্ত চেয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি এক সপ্তাহে চার দিনের ব্যবধানে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে তিনটি ভয়ংকর বিস্ফোরণ এবং একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ভাবিয়ে তুলছে সচেতন মহলকে। তারা বলছেন, দেশে চলমান নানা সংকটের মাঝে এমন দুর্ঘটনা অনেক কিছুই ইঙ্গিত দেয়। আবার সেগুলো নাশকতা হলে তো আরও ভয়ংকর ঘটনা। বিশেষ করে কুইন মার্কেটে বিস্ফোরণের ঘটনার ৮ ঘণ্টার ব্যবধানে তেজগাঁও টিসিবির গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি সরকারের শীর্ষ মহলের ভাবনায় আঘাত হেনেছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনা প্রকৃত দুর্ঘটনা নাকি অন্তর্ঘাতমূলক কিছু, তার সঠিক তদন্ত প্রয়োজন। কী কারণে এমন বিস্ফোরণ, কেন এত মানুষকে প্রাণ হারাতে হলো, সেটার সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, ঢাকার সায়েন্সল্যাব, এখন সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। এ ঘটনাগুলো কোনো কিছুর ইঙ্গিত কি না, সেটাও গোয়েন্দাদের দেখতে হবে।

গতকাল সকালে গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, কয়েক বছর আগেও দেখা গেছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ধরেছেও। তাই সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এ ঘটনার প্রকৃত কারণ বের করতে হবে। কোনো বিস্ফোরক নাকি রাসায়নিক থেকে এ ঘটনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

একাধিক সূত্র বলছে, কুইন মার্কেটের বেসমেন্টে গত সাত বছর আগেও একটি খাবারের রেস্টুরেন্ট ছিল। রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে ছিল অনেকগুলো গ্যাসের চুলা। বর্তমানে বেসমেন্টে রেস্টুরেন্টের জায়গায় বাংলাদেশ স্যানিটারি ছিল। পুলিশ, র‌্যাবসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরাও বলেছেন, বিস্ফোরণের সূত্রপাত হয়েছে বেসমেন্ট থেকে। প্রাথমিক তদন্তে তারা এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। অন্যদিকে, তারা মার্কেটের মালিক প্রয়াত রেজা আহমেদের ছেলে মিন্টু এবং স্থানীয় একজনকে আটক করে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কুইন মার্কেটে তিতাসের কতগুলো গ্যাসলাইন ছিল তা খতিয়ে দেখতে হবে। এসব লাইনে কোনো লিকেজ ছিল কি না নিশ্চিত হতে তিতাসের বাইরে একাধিক সংস্থা দিয়ে পরীক্ষা করানো উচিত। সেপটিক ট্যাংকির বিষয়টি তো গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। কারণ সুয়ারেজ লাইন দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার না থাকলে মিথেন গ্যাস জমে ওপরের দিকে উঠে আসতে পারে।

ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেছেন, সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের কারণ জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হলে তারা সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন, কেন বিস্ফোরণ হয়েছে। তবে বিস্ফোরণের পর ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ইমারতে পরিণত হয়েছে। ভবনের বেসমেন্ট ও নিচতলা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যথেষ্ট সতর্কতা নিয়ে পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারকাজ করছে। ফায়ার সার্ভিসকে পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা সহযোগিতা করছে।

যা বলছে সংস্থাগুলো : সম্ভাব্য পাঁচটি উপায়ে গ্যাস জমতে পারে বলে মনে করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল। ভবনের ধ্বংসস্তূপ, আহত ও নিহত হওয়ার ধরন দেখে তারা বলছে, ভবনের মাটির নিচে পানির ট্যাংকি থেকে গ্যাস নির্গত হতে পারে; দুটি ভবনের মাঝখানে একটি সেপটিক ট্যাংকি ছিল, সেখান থেকে গ্যাস নির্গত হতে পারে; বিচ্ছিন্ন হওয়া কোনো গ্যাসের লাইন থেকে গ্যাস জমতে পারে বা দেয়ালে মিথেন গ্যাস জমে থাকতে পারে; পয়ঃনিষ্কাশন লাইনের পাইপ লিকেজ হয়ে গ্যাস জমতে পারে অথবা ভবনে থাকা বড় জেনারেটর থেকেও কোনোভাবে গ্যাস জমতে পারে।

সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, যে কোনো উপায়েই হোক ভবনের আবদ্ধ কক্ষে গ্যাস জমেছিল। সেখানে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা অন্য কোনো উপায়ে স্পার্ক থেকে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে। এ বিস্ফোরণ কোনো নাশকতা নয় বলেও প্রাথমিকভাবে মতামত দিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, কোনো বিস্ফোরক বা আইইডি (ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) সার্কিটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। কোনো বিস্ফোরক ব্যবহার হলে ধোঁয়ার সময় কোনো রঙিন বা কালো ধোঁয়া হয়। কিন্তু সেখানে এমন কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া কোনো লাশের আঘাতের ধরনও বলছে এটি গ্যাস জমে বিস্ফোরণ হয়েছে। দগ্ধ ব্যক্তিদের আহত হওয়ার ধরন দেখে মনে হয়েছে, গ্যাসের স্তরটি তিন থেকে পাঁচ ফুট উচ্চতায় ছিল। এতে মনে হয়েছে এই বিস্ফোরণ মিথেন গ্যাস থেকে হয়েছে।

এদিকে, গতকাল দুপুরে র‌্যাব সদর দফতরের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের উপ-পরিচালক মেজর মশিউর রহমান বলেন, গ্যাসীয় বিস্ফোরণের কারণে এমনটা হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। তবে বেসমেন্টে আমরা এখনো ভালোভাবে পৌঁছাতে পারিনি। সেখানে অনেক গার্বেজ পড়ে আছে।

তিনি আরও বলেন, তবে এই ভবনের বেসমেন্টেই এক সময় রেস্টুরেন্ট ছিল বলে আমরা জানতে পেরেছি। তাই সেখানে গ্যাসলাইন ছিল। ওই লাইন থেকে আরও কোনো অবৈধ সংযোগ ছিল কি না তা তদন্ত সাপেক্ষে বলা যাবে।

সর্বশেষ খবর