শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

ছেলেবেলার তারাবির দিনগুলো

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ছেলেবেলার তারাবির দিনগুলো

তখনো মাদরাসায় ভর্তি হইনি। পড়ালেখার চাপ নেই। ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাছারিতে বিসমিল্লাহর সবক দিয়ে শুরু হতো দিন। মক্তব থেকে ফিরে নাস্তা খেয়ে সারাদিনের জন্য বেরিয়ে পড়তাম। মক্তবের পর তখন একটাই বড় কাজ ছিল- খেলাধুলা। বাবা বলতেন, ‘যত খুশি খেল কোনো আপত্তি নেই, তবে       খাওয়ার সময় এসে ঠিকমতো খেয়ে যেও।’ খাওয়ায় অনিয়ম হলে স্বাস্থ্য খারাপ করবে বলে বাড়তি সতর্ক থাকতেন বাবা। এক দুপুর পর্যন্ত খেলাধুলা করে বাড়ি আসতাম। কোনো কোনো দিন মা খুঁজে আনতেন। মা ঠিক জানতেন সন্তান কখন কোথায় থাকতে পারে। গোসল করার পর খাওয়ার পালা। গোসল করতে গেলেও এক-দুই ঘণ্টা অনায়াসেই পার হয়ে যেত পুকুরে ডুবাতে ডুবাতে। দুপুরের খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্য বলতেন আম্মা। আমাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন আর আমি ফাঁকি দিয়ে খেলার মাঠে চলে এসেছি এমন অনেকদিন হয়েছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত খেলা চলত তারপর ঘরে ফেরা। সন্ধেবেলায় কুপির আলোতে দাদা-দাদুর কোলে বসে গল্প শোনা। এশার আজানের পরপরই ঘুমিয়ে পড়া। এই ছিল আমাদের সময়কার শৈশবের পরিচিত দৃশ্য। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন শবেবরাত চলে আসে। আম্মা সুন্দর করে সাজিয়ে মসজিদে পাঠান। মিলাদ-দোয়া শেষে অনেক রাতে ঘরে ফিরি। তখন রাত ৯টাই অনেক রাত ছিল। শবেবরাতের পর থেকেই সবার চোখে-মুখে রমজান রমজান ভাব চলে আসে। চারপাশের পরিবেশটাও রোজার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। একদিন আব্বা অনেক বাজার নিয়ে আসেন। সেখানে খেজুর, ছোলা, আলু থাকে। আমার জিজ্ঞাসু চেহারার দিকে তাকিয়ে আম্মা বলেন, ‘এগুলো রোজার বাজার।’ আম্মা বাজারের ব্যাগ খুলে সদাই গুছিয়ে রাখেন। আমি পাশে বসে দেখতাম। তবে আমরা ছোটরা সেভাবে রোজার অপেক্ষায় থাকতাম না। মাঠেঘাটে ছুটে চলার ফাঁকে রোজার কথা মনেই থাকত না। হঠাৎ একদিন শুনি আজ চাঁদ ওঠবে। রমজানের চাঁদ। আজানের পরপরই মাঠে দৌড় দিতাম চাঁদ দেখার জন্য। এক ফালি বাঁকা ফিনফিনে চিকন চাঁদ দেখে সে কী আনন্দ! সে কী উল্লাস! তারপর বাড়ি এলে আম্মা পরিপাটি করে সাজিয়ে দিতেন তারাবির জন্য। ছোটবেলার তারাবি ছিল মিষ্টি দুষ্টুমিতে ভরা। তারাবির জন্য সেজদায় যাওয়ার সময় এ ওর পিঠে কিল দিয়ে নিপাট ভদ্র ছেলের মতো নামাজ শেষ করতে অনেক ছেলেকে দেখতাম। আমাদের ঠিক পেছনে যারা দাঁড়াত কেন যেন তারা হঠাৎ শব্দ করে হেসে ওঠত। হাসি চাপানোর চেষ্টা সত্ত্বেও শব্দটা আটকাতে পারত না। সামনে থেকে আমরা বুঝতে পারতাম না কেন হাসছে তারা। এভাবে শৈশবের রোজা, তারাবি, ঈদ কাটিয়ে আজ একবিংশ শতাব্দীর সব সুবিধাসংবলিত মসজিদগুলোতে তারাবি পড়ছি, পড়াচ্ছি। আজকের তারাবির সঙ্গে সেদিনের তারাবির প্রেমের মিল নেই। সেদিনের তারাবি ছিল যেন একটি মাসুম শিশুর আল্লাহর দরবারে সেজদায় লুটিয়ে পড়ার ফুটফুটে দৃশ্য। আর আজকের কিছু কিছু তারাবি দেখলে মনে হয় এ যেন একজন পাপী ব্যস্ত মানুষের তাড়াহুড়োয় তারাবি শেষ করার রোবটিক চিত্র। তারাবি পড়তে হয়, না পড়লে গুনাহ হবে, সুন্নতে মুয়াক্কাদা ছুটে যাবে- এ ভয়ে তারাবি পড়েন আমাদের অনেকে। কিন্তু যে প্রেম ও আবেগ নিয়ে নবীজি (সা.) তারাবি পড়েছেন, কিয়ামুল্লাইল করেছেন, সাহাবিরা সারা রাত নামাজে দাঁড়িয়েছিলেন, আল্লাহর ভয়ে জার জার কেঁদেছেন- আমাদের তারাবিতে, তাহাজ্জুদে তো সে অনুভূতি জাগে না। এটা সত্যি যে, এ লেখা যারা পড়ছেন তাদের অনেকেরই হুজুরি কালব আছে। নামাজে দাঁড়ালে চোখে পানি আসে। কিন্তু আমাদের বেশিরভাগ মুসল্লিই প্রেমহীন তারাবি-তাহাজ্জুদ আদায় করে রমজান কাটিয়ে দেই। ছেলেবেলার যে মাসুম মন ছিল অন্তত সে মন নিয়েও যদি আল্লাহর কদমে সেজদায় লুটিয়ে পড়তে পারতাম, কেঁদে বলতে পারতাম- হে আল্লাহ! নফসের ধোঁকায় পড়ে গুনাহ করে ফেলেছি, তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও। আল্লাহ অবশ্যই আমাদের ক্ষমা করতেন।

বর্তমানে তারাবির রাকাত নিয়ে বিতর্ক, ঝগড়াঝাটি, গালাগালি, নোংরামির চূড়ান্ত পর্যায়ও দেখছি আমরা। তারাবির রাকাত নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। যে যার মাজহাব মতো তারাবি আদায় করবেন। কিন্তু তারাবি নিয়ে ঝগড়া করাটা কোন ইসলামের শিক্ষা? আমাদের মাজহাব মতে তারাবি সুন্নতে মুয়াক্কাদা। কোনো কোনো মাজহাবে সুন্নত। কিন্তু এ নিয়ে ঝগড়া করতে হবে এমনটা কোথায় বলা আছে? একশ্রেণির মানুষের কর্মতৎপরতা দেখে মনে হয় ফেতনা বা ঝগড়া সৃষ্টি করে হলেও মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছেন তারা। তাদের বলার ভঙ্গি, ভাষা খুবই আক্রমণাত্মক। এটা উচিত নয়। আসুন! বিভেদ ভুলে আমরা ভ্রাতৃত্বের সমাজ গড়ে তুলি। এতে আল্লাহর নবী খুশি হবেন। নবী খুশি হলে আল্লাহও খুশি হবেন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের হারানো নেয়ামত ফিরিয়ে দিন, আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি পীর সাহেব, আউলিয়ানগর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর