সোমবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুসলিম উম্মাহ সম্পর্কে কী বলেছে কোরআন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মুসলিম উম্মাহ সম্পর্কে কী বলেছে কোরআন

ছোট বড় মিলিয়ে পৃথিবীতে প্রায় ৪ হাজার ২০০ এর মতো ধর্ম আছে। কালের আবর্তনে অনেক ধর্ম হারিয়ে গেছে। আবার কোনো কোনো ধর্ম আপডেট হয়ে নতুনভাবে মানুষের সামনে আলোর মশাল নিয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ধর্ম সম্পর্কে কোরআন কী বলে? প্রথম কথা হলো, কোরআন       বা নবীজি (সা.) কখনোই অন্যসব ধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক এটা চায় না। বরং কোরআন চায় পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে সব ধর্মের উপস্থিতিতে ইসলাম হবে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। কোরআন হবে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ বা জীবন বিধান। অন্যসব ধর্মগুরু ও ধর্মগ্রন্থ যখন মানুষের কল্যাণে প্রয়োজনীয় বিধি ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হবে কোরআন তখন তাদের পথ দেখাবে। এক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। এ দায়িত্বকে কোরআন ‘ওয়াসেতা বা মধ্যস্থতা অথবা মধ্যমপন্থা’ নাম দিয়েছে। সুরা বাকারার ১৪৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘ওয়া কাজালিকা জাআলনাকুম উম্মাতাও ওয়াসাতাল্লিতাকুনু শুহাদাআ আলান্নাসি ওয়াকুনার রাসুলা শাহিদা। অর্থাৎ হে উম্মতে মুহাম্মদি কোরআনের একনিষ্ঠ অনুসারীরা! এভাবে আমি তোমাদের মধ্যমপন্থা উম্মত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছি। তোমরা বিশ্বমানবের পর্যবেক্ষক, আর তোমাদের পর্যবেক্ষক হলেন আমার রসুল।’

এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মাদির ব্যাপারে ‘ওয়াসেতা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। এ শব্দের আভিধানিক ও ব্যবহারিক অর্থ নিয়ে মুফাসসিরগণ বেশ সুন্দর আলোচনা করেছেন। ইমামে আহলে সুন্নাত আহমদ রেজা খান বেরলভি (রহ.) কানজুল ইমানে ওয়াসেতা শব্দের অর্থ করেছেন ‘শ্রেষ্ঠত্ব’। অর্থাৎ, পৃথিবীর যত উম্মত বা জাতি আছে ও ছিল উম্মতে মুহাম্মাদি সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। রেজা খান বেরলভী (রহ.) এ মতটি নিয়েছেন মূলত আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) থেকে। ইবনে কাসির (রহ.) ওয়াসেতার অর্থ করেছেন ‘ভালো ও শ্রেষ্ঠ’। আল্লামা কাজি সানাউল্লাহ পানিপথী (রহ.) তাফসিরে মাজহারির প্রথম খন্ডে ওয়াসেতার অর্থ লিখেছেন ‘মধ্যমপন্থা।’ সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি (রা.) এ থেকে মারফু সনদে এ অর্থই বর্ণিত হয়েছে। ওয়াসেতার আরও কয়েকটি অর্থ পাওয়া যায়। কোনো স্থানের সমান দূরত্বে অবস্থিত দুটি সীমান্তের মধ্যভাগকে ওয়াসেতা বলা হয়। সহজ কথায় কোনো সমান্তরাল বৃত্তের কেন্দ্রকে ওয়াসেতা বলা হয়। আরও সহজ একটি অর্থ রয়েছে- নিরপেক্ষ ও ন্যায় বিচারক ব্যক্তিকে ওয়াসেতা বলা হয়। ওয়াসেতার ব্যাখ্যায় বাংলাদেশের প্রখ্যাত কোরআন গবেষক মোহাম্মদ আকরম খাঁ বলেন, ‘ওয়াসেতার একটি অর্থ হলো কোনো দুটি চরমপন্থি মতের সুসঙ্গত সমন্বয়কারী ব্যক্তি বা জামাত। আভিধানিক ও ব্যবহারিক অর্থের সামঞ্জস্য করার জন্য আমি ওয়াসেতার অর্থ লিখেছি ‘মধ্যস্থ’। আল্লাহ মুসলমানদিগকে মধ্যস্থ উম্মতরূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারা সমগ্র বিশ্ব মানবের পর্যবেক্ষক আর তাদের পর্যবেক্ষক খোদ আল্লাহর রসুল (সা.)।’ (তাফসিরসহ কোরআন শরিফ, ১ম খন্ড, ১৪৭ পৃষ্ঠা।) আমরা যদি ইবনে কাসিরের অর্থ অনুযায়ী উম্মতে মুহাম্মাদিকে শ্রেষ্ঠ উম্মত ধরে নিই তাহলে এই শ্রেষ্ঠত্ব কীসের ভিত্তিতে হবে? এ প্রশ্নের উত্তরে কাজি সানাউল্লাহ পানিপথি (রহ.) বলেন, আচরণ ও জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব। পৃথিবীর সব উম্মত বা জাতির চেয়ে উম্মতে মুহাম্মাদির আচরণ হবে সবচেয়ে সুন্দর, কোমল। দুনিয়ার সব জ্ঞান ও প্রযুক্তি থাকবে উম্মাতি মুহাম্মাদির দখলে। একটা সময় এটাই ছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের সব শাখার আবিষ্কার ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কোরআনের অনুসারীরা। আজ সে সব শুধুই অতীত। আবার আমরা যদি আকরম খাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী ওয়াসেতা অর্থ নিরপেক্ষ ও মধ্যস্থ উম্মত ধরে নিই তাহলে বলতে হবে-বিশ্বের অন্যান্য জাতি ও ধর্মগোষ্ঠীর মাঝে বিদ্যমান সমস্যা মোকাবিলায় মুসলমানরা হবে বিচক্ষণ বিচারক। তারা সমস্যা ও বিরোধ উসকে দেবে না। বরং কীভাবে চরমপন্থি ও শিথিলপন্থি গোষ্ঠীকে এক কাতারে নিয়ে এসে বাসযোগ্য পরিবেশবান্ধব পৃথিবী গড়া যায় সে পরিকল্পনা ও বাস্তব পদক্ষেপ নেবে। উম্মতে মুহাম্মাদির সৃজনশীল নেতৃত্বে সব ধর্ম ও গোত্র একসঙ্গে মিলেমিশে শান্তিময় পৃথিবী গড়বে। যেমনটা আমরা দেখতে পাই রসুল (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদিনের রাষ্ট্রব্যবস্থায়। সেখানে ইহুদি খ্রিস্টান মাজুসি সবাই সমান সুযোগ ও সুবিধা ভোগ করত। একবার রসুল (সা.) এর কাছে যখন একজন সাহাবি ও ইহুদির মোকাদ্দমা পেশ করা হলে তিনি ন্যায় বিচার করে ইহুদির পক্ষে রায় দেন। সে বিচার পরবর্তীতে হজরত আবু বরক (রা.) এর কাছে উপস্থাপন করা হলে তিনি ন্যায় বিচারের বিপক্ষে ও রসুল (সা.) এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রায় দিতে কেঁপে ওঠেন। হজরত ওমরের কাছে বিচার নিয়ে গেলে তিনি বিচারপ্রার্থী মুসলমানকে হত্যা করেন এই বলে যে, রসুল (সা.) এর বিচার যে না মানবে তার শাস্তি এটাই। শেষ করছি আকরম খাঁর আফসোস মাখা কথা দিয়ে। তিনি বলেছেন- ‘হায়! মুসলমানদের যেখানে অন্য ধর্মগোষ্ঠীর মানুষকে এক কাতারে নিয়ে এসে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার মিশন কাঁধে, সেখানে তারা নিজেরাই দলাদলি ও মত নিয়ে মাতামাতিতে জর্জরিত। অন্যদের তো দূরের কথা, নিজেরাই এক কাতারে দাঁড়াতে পারছে না। এ জন্য মুসলমি উম্মাহকে অবশ্যই কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে।’

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি পীর সাহেব, আউলিয়ানগর।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর