বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা

তদন্তে গোয়েন্দারা মাঠে

মাহবুব মমতাজী

রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেটের আগুনটি আসলে নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা। এ নিয়ে সন্দেহ মার্কেটটির খোদ ব্যবসায়ী ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। ইতোমধ্যে রহস্য বের করতে মাঠে গোয়েন্দারা কাজ করছেন বলে জানা গেছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এর আগে বঙ্গবাজারে বারবার আগুন লেগেছে। এবারও মার্কেট দখলের জন্য কেউ লাগিয়ে দিয়েছে কি না সন্দেহ। আগুনের কারণ খুঁজতে গতকাল ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) একাধিক টিম এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্যরা।

গতকাল বিকালেও পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, ‘ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নাশকতার কোনো ঘটনা থাকলে কমিটির তদন্তে বের হয়ে আসবে। আমরা সেই রিপোর্টের অপেক্ষায় থাকব। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবশ্যই নেব।’

গতকাল সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বঙ্গবাজার মার্কেটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। খবর পাওয়ার দুই মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট। বেলা ১১টায় ৫০টি ইউনিট ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। এর পরও আগুন বেপরোয়া। ৫০টি ইউনিটের সঙ্গে যোগ দেয় বাংলাদেশ সেনা ও বিমান বাহিনীর সাহায্যকারী ও নৌবাহিনীর সম্মিলিত দল। আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়েছে বাহিনীর হেলিকপ্টার ইউনিট ও জলকামান। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে আগুনের ঘটনা ঘটেছে ১ লাখ ১০ হাজার ৪৯২টি। এসব ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। গত বছর আগুন লাগার ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। গত ১০ বছরে ক্ষতির পরিমাণ সোয়া ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ২০১২ থেকে গত বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আগুনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ১৭৬ জন। এর মধ্যে ২০১২ সালে ২১০ জন, ২০১৩ সালে ১৬১ জন, ২০১৪ সালে ৭০ জন, ২০১৫ সালে ৬৮ জন, ২০১৬ সালে ৫২ জন, ২০১৭ সালে ৪৫ জন, ২০১৮ সালে ১৩০ জন, ২০১৯ সালে ১২০ জন, ২০২০ সালে ১৫৩ জন, ২০২১ সালে ৬০ জন এবং গত বছর ১০৬ জন। এ সময়ের আহতের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, আগুন লাগার কারণ বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, লিকেজ গ্যাস লাইন কিংবা দাহ্য পদার্থ।

গতকালের আগুন নিয়ে ব্যবসায়ীদের সন্দেহ, এই অগ্নিকা- পরিকল্পিত নাশকতা হতে পারে। বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির দফতর সম্পাদক বি এম হাবিব অভিযোগ করেন, জমি ফাঁকা করার জন্য অগ্নিসংযোগ বা নাশকতার ঘটনা ঘটানো হতে পারে। দীর্ঘদিন একটি মহল অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। মার্কেটের ভিতরে আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্যাস ছিল। কিন্তু সকালবেলা হওয়ায় তা ব্যবহার করা যায়নি। বেলা সাড়ে ১১টায় যখন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বঙ্গবাজার এনেক্স টাওয়ারের দক্ষিণ পাশের আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করছিলেন। এ সময় উল্টো দিকের বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটের মাহফুজ নামে এক ব্যবসায়ী তার দোকানের সব মালামাল তড়িঘড়ি করে বের করে আনেন। এসব রাখেন সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের সামনের রাস্তায় আইল্যান্ডের ওপর। প্রায় পাঁচ বস্তা কাপড় পাহারা দিচ্ছিলেন আর অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিলেন আগুনে জ্বলতে থাকা বঙ্গবাজারের দিকে। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘বৃহত্তর বঙ্গবাজারের আগুনে পুড়ে যাওয়া শাড়ি আর লুঙ্গিগুলো উদ্ধার করে লোকজন রাস্তার এ-পাড়ে যখন রাখেন, তখন এই আগুন থেকে ইসলামিয়া মার্কেটের মসজিদে আগুন লাগে। এরপর মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে যায়। আগুন লাগার পরই সকাল দিকে অনেক মালামাল লুট হয়। অনেকের ক্যাশে থাকা নগদ টাকাও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রত্যেকের ক্যাশে কম করে হলেও ৫০ হাজার টাকা ছিল। মালও প্রায় ২০-২৫ লাখ টাকার। কারও কারও ১ কোটি টাকারও মালামাল ছিল। এত সকালে আগুন কেমনে লাগল, আর এত দ্রুত কেমনে ছড়াইল, এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমাদের এত ক্ষতি কেমনে পূরণ করমু!’ এসব বলছিলেন আর চোখের পানি মুছছিলেন ব্যবসায়ী মাহফুজ। তার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। এখন তারা রাজধানীর বনশ্রীতে স্থায়ী বসবাস করেন।

তদন্ত কমিটি : গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানান, আগুন লাগার কারণ এবং ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে তদন্তের দায়িত্বে কারা রয়েছেন তা তাৎক্ষণিকভাবে জানাননি তিনি।

ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি অগ্নিকান্ডের কারণ অনুসন্ধান, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পৃথক আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

২৮ বছর আগেও আগুনে ছাই বঙ্গবাজার : সব ধরনের তৈরি পোশাক ও পোশাক তৈরির কাটপিস সুলভ মূল্যে পাওয়া যায় বলে রাজধানীর বঙ্গবাজারের পরিচিতি ছিল দেশজুড়ে। শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশ থেকেই ক্রেতারা আসতেন এই বাজারে সস্তায় পছন্দের পোশাক কিনতে। এমনকি বিদেশি ক্রেতারাও ভিড় করতেন। বাজারটি বঙ্গবাজার নামে পরিচিতি অর্জন করলেও বস্তুত এখানে গুলিস্তান, মহানগরী, মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, এনেক্স ও আদর্শ হকার্স মার্কেট নামের অন্য মার্কেটের দোকানগুলো একত্রে মিশেছে। জানা যায়, ১৯৯৫ সালে এক ভয়াবহ অগ্নি-দুর্ঘটনায় দেশ-বিদেশে আরও ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে বঙ্গবাজার। সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল বাজারটি। ওই সময়ও ভোরের দিকে আগুন লাগার কারণে বেশির ভাগ দোকানই ছিল বন্ধ এবং দোকানমালিকরা ছিলেন বাসায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর