শনিবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা
ঝুঁকিতে মার্কেট-শপিং মল

আগুন নিভল ৭৫ ঘণ্টা পর

সরানো হচ্ছে ধ্বংসস্তূপ

আলী আজম

রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুন পুরোপুরি নেভাতে সময় লেগেছে ৭৫ ঘণ্টা। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় আগুন সম্পূর্ণ নেভানোর ঘোষণা দেয় ফায়ার সার্ভিস। এর আগে, মঙ্গলবার সকাল সোয়া ৬টায় বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। ওইদিন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এর পরই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে আগুনে আংশিক ক্ষতি হওয়া মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, এনেক্সকো টাওয়ার, বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্স ও বঙ্গ ইসলামীয়া মার্কেট খুব দ্রুত খুলতে চান ব্যবসায়ীরা। এসব ভবনে এখনো বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি।

ক্ষতিগ্রস্ত ভবন থেকেও জিনিসপত্র সরানো, দেওয়ালে রং দেওয়া এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে মার্কেট খোলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করে সহযোগিতা ও ঈদের আগেই ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। সে লক্ষ্যেই ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের নাম, পরিচয়, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও ধরনসহ যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বঙ্গবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জনসাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নিচ্ছে সিটি করপোরেশন।

গুলিস্তান মার্কেটে তিনটি দোকান ও একটি গোডাউনের মালিক ফারুক ও জুয়েল নামে দুই ভাই। তারা জানান, তাদের দোকানের নাম সাব্বির অ্যান্ড ফাতেমা হোসেন। দোকানে শিশুদের পোশাক ও প্যান্ট ছিল। আগুনে সব পুড়ে গেছে। দোকান ও গোডাউন মিলে ৪০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিন দোকানে ৯ লাখ টাকা অ্যাডভান্স করা হয়েছিল। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল ৩০ লাখ টাকা। বঙ্গবাজার মার্কেটে চয়নিকা গার্মেন্টসের মালিক মোজাম্মেল হোসেন জানান, তিনি তিনটা দোকান গড়ে তুলেছিলেন। শার্টের জন্য তার দোকান বিখ্যাত ছিল। তিনি ক্যাশ থেকে আড়াই লাখ উদ্ধার করতে পারলেও দোকানের সব মালামাল পুড়ে গেছে। আগুনে তার দেড় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ী সোহাগ দেওয়ান জানান, তার দেওয়ান ফ্যাশন নামে দুটি দোকানে লেডিস ও প্যান্ট আইটেম ছিল। দুই দোকানের ক্যাশে থাকা নগদ ১ লাখ ১০ হাজার টাকাসহ দোকানের সব মালামাল পুড়ে গেছে। তার ক্ষতি হয়েছে ৪০ লাখ টাকা।

আগুনে চারটি মার্কেট পুরোপুরি পুড়ে গেলেও আংশিক ক্ষতি হয় এনেক্সকো টাওয়ার, মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্স ও বঙ্গ ইসলামীয়া মার্কেটের। এর মধ্যে সাত তলা এনেক্সকো টাওয়ারের চতুর্থ তলা থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নিচের ফ্লোরগুলোয় থাকা দোকানগুলো ভালো রয়েছে। মহানগর শপিং কমপ্লেক্সের পেছনের অংশে থাকা ৩০০ শতাধিক দোকান পুড়ে গেছে। সামনের দিকের দোকানগুলো ভালো রয়েছে। আর বিপরীতে থাকা বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্স ও বঙ্গ ইসলামীয়া মার্কেটের সামনের অংশের দোকানগুলো আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এসব মার্কেটের ব্যবসায়ীরা দ্রুত দোকান খুলে ব্যবসা চালু করতে চাচ্ছেন।

বঙ্গ হোমিও মার্কেটের নিচতলায় দুটি দোকান ছিল মোহাম্মদ শফিকের। তার দোকানে চলছে শাটার পরিবর্তন ও দেওয়ালে রং করার কাজ। শফিক বলেন, এ মার্কেটে দু-তিনটি দোকান পুড়েছে। আগুনের তাপে অনেক দোকানের শাটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসি নষ্ট হয়েছে। এগুলো ঠিক করা হলে মার্কেট চালু হবে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা মার্কেট খুলতে পারব। সেই অনুযায়ী কাজ চলছে। ইউনুস নামে আরেক ব্যবসায়ী জানান, আগুনে বঙ্গ ইসলামীয়া মার্কেটে ২০-৩০টা দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মার্কেটের সামনের ফুটপাতে প্রচুর নষ্ট কাপড় পড়ে আছে। সেগুলো দু-এক দিনের মধ্যে পরিষ্কার করা হবে। ঈদের আগে সপ্তাহ খানেক বেচাকেনা করতে পারলেও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবেন।

মার্কেট খোলার বিষয়ে এরই মধ্যে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা হয়েছে ব্যবসায়ীদের। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী সমিতির নেতা ও সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সিটি করপোরেশনের অনুমতি মিললেই দোকান খুলতে চান তারা। মহানগর শপিং কমপ্লেক্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজনেস অ্যাসোসিয়েট প্রাইভেট লিমিটেডের সহসভাপতি জহির মাহমুদ বলেন, বুধবার মেয়রের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের বৈঠক হয়েছে। রবিবার আবারও মিটিং আছে। ব্যবসায়ীরা চাচ্ছেন মার্কেট খুলতে। কিন্তু এক্ষেত্রে সমিতি ও সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্তের বিষয় রয়েছে। মার্কেটে এখন পরিষ্কারের কাজ চলছে।

এনেক্সকো টাওয়ার দোকান মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জহিরুল ইসলাম জানান, তাদের মার্কেটের অংশিক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত দোকানগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে। এসব কাজ হয়ে গেলে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে মার্কেট খুলে দেওয়াটা ভালো হবে। ধ্বংসস্তূপ থেকে পোড়া ও ক্ষতিগ্রস্ত জিনিসপত্র সরানোর কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অনুমতিক্রমে মেসার্স বুশরা ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ দেওয়া হয়েছে। এসব ধ্বংসস্তূপ ৪০ লাখ টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে মেসার্স বুশরা ট্রেডার্স। তারা এই ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নেওয়ার পর সেখানে ব্যবসায়ীদের জন্য অস্থায়ী বসার জায়গা করে দেবে।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. নাজমুল হুদা বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর এখান থেকে অনেক মালামাল চুরি হয়ে যায়। ওই সময় চুরি ঠেকানো যায়নি। তবে এখনো অনেক পোড়া স্তূপ পড়ে রয়েছে। সেগুলো দরপত্রের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠানকে আমরা বিক্রি করে দিয়েছি। আপাতত খোলা জায়গায় একটি দোকানে দুজন করে বসার সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। এখানে তো ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি ব্যবসা করার জন্য বসবে না। ঈদের আগে বসতে পারলে কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও মালিকদের তালিকা করার কাজ চলছে।

বৃহস্পতিবার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান জানিয়েছিলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করে সহযোগিতা ও ঈদের আগেই ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ করে দেওয়া হবে। সেই লক্ষ্যে মার্কেটটির বিপরীতে অস্থায়ী ক্যাম্প গড়ে তুলেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের নাম, পরিচয়, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও ধরনসহ যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেখানে আলাদা ডেস্কে বঙ্গ, আদর্শ, মহানগর, গুলিস্তান ও এনেক্সকো টাওয়ারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করা হচ্ছে। গতকাল বিকাল ৪টা পর্যন্ত ৭১৮ জন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী এবং ৫৫৫ কর্মচারীর নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

এদিকে, মার্কেটটি পশ্চিম পাশে এনেক্সকো টাওয়ারের সামনে অস্থায়ী ক্যাম্প খুলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জিডি লিপিবদ্ধ করছে পুলিশ। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ জানান, গতকাল বিকাল পর্যন্ত অস্থায়ী ক্যাম্পে ৩৮টি জিডি হয়েছে। জিডিতে ক্ষয়ক্ষতি, উদ্ধার, খোয়া কিংবা চুরি যাওয়া মালামালের পরিমাণ ও আর্থিক ক্ষতি উল্লেখ করেছেন ব্যবসায়ীরা।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর