রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

বদরের যুদ্ধ ও আমাদের শিক্ষা

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

বদরের যুদ্ধ ও আমাদের শিক্ষা

আল্লাহতায়ালা বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী রহমাতুল্লিল আলামিন হজরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়ত ও রিসালাত প্রকাশ করেন পবিত্র রমজান মাসেই। তিনি রমজান মাসেই নাজিল করেন পবিত্র কোরআন এবং এই মাসের ১৭ তারিখ অর্থাৎ ১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরে আত্মরক্ষা ও প্রতিরক্ষামূলক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আজ সেই ১৭ রমজান। বদর একটি ইতিহাস। বদরের ঐতিহাসিক ময়দানে আজও প্রতি বছর হাজারো হাজি সাহেবের আগমন ঘটে। তারা রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো দেখে নিজেদের চক্ষু শীতল করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দোয়া কবুলের স্থান দেখে আল্লাহর কাছে দোয়া করে করেন। দ্বিতীয় হিজরি সনে রমজান মাসের ১৭ তারিখে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বদরের বিজয়ের ১৩ দিন পর ১ শাওয়াল প্রথম ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপন করা হয় এবং ১০ জিলহজ ঈদুল আজহা পালন করা হয়। সব নবী-রসুলগণ সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের বাণীর দাওয়াত দিয়েছেন অহিংস পন্থায়। আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও সেই সুন্দর-সঠিক পদ্ধতিতে ইসলামের বাণীর দাওয়াত দিচ্ছিলেন। কিন্তু তখন মক্কার কিছু কাফির ও মুশরিক এই শান্তির বাণী প্রচারে অশান্তির সৃষ্টি করে। তিন বছর আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘শিআবু আবি তালিবে’ বন্দি করে রাখে। তিনি ইসলামের দাওয়াতি কাজে পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে তায়েফ গমন করলে নির্মমভাবে নির্যাতনে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জর্জরিত করে। মক্কায় ফিরে আসতে চাইলে প্রবেশে বাধা প্রধান করে। ‘দারুন নাদওয়া’য় শয়তানের পরামর্শে নবীজিকে হত্যার নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র করে। সব চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে নবুওয়তের ১৩তম বছরে আল্লাহর নির্দেশে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসে প্রিয় জন্মভূমি মক্কা শরিফ ছেড়ে হিজরত করে পবিত্র মদিনায় চলে যান। মদিনার শান্তিকামী মানুষগুলো এতে আনন্দিত হয়। পরম আনন্দে প্রিয় নবীজির সোহবত গ্রহণ করতে থাকেন। তা দেখে মুনাফিকদের গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায়। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই। বছর যেতে না যেতেই তারই প্ররোচনায় মুনাফিক চক্রের ষড়যন্ত্রে মক্কার কুরাইশ পৌত্তলিকরা হিজরতের দ্বিতীয় বছর ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে ‘আশহুরে হুরুম’ বা যুদ্ধনিষিদ্ধ মাস চতুষ্টয়ের অন্যতম রমজানেই মদিনা আক্রমণ করে বসে। কুরাইশ বাহিনীর ১ হাজার সৈন্য, ১০০টি ঘোড়া, ৭০০টি উট ছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার পিতা উতবা, চাচা শায়বা, ভাই ওয়ালিদ এই দলের নেতৃত্বে ছিল। কুরাইশরা ৪৫০ কিলোমিটার দূরে এসে আক্রমণ করল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনার পবিত্রতা ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মুহাজির ও আনসার সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে মদিনা শরিফ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বে বদরে এসে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই আত্মরক্ষামূলক প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবি ছিলেন ৩১৩ জন, সঙ্গে মাত্র দুটি ঘোড়া ও ৭০টি উট। তাঁরা মদিনা থেকে তিন দিনে বদর গিরিপ্রান্তরে পৌঁছালেন। এই আত্মরক্ষামূলক ও প্রতিরোধমূলক যুদ্ধে মহান রব্বুল আলামিন মুসলমানদের ঐতিহাসিক বিজয় দান করেন এবং কাফিররা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। আসুন আমরা ঐতিহাসিক বদরের শিক্ষা জেনে নিই। ১. বদর যুদ্ধের পর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থান ছিল পরাজিত আত্মসমর্পণকারীদের প্রতি কোনো প্রকার কষ্ট না দেওয়া। তিনি ক্ষমার পন্থা অবলম্বন করলেন। ২. বদরের বন্দিদের প্রতি নবী (সা.) যে আদর্শ ও ব্যবহার দেখালেন, জগতের ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। নবীজির আদেশে মদিনায় আনসার এবং মুহাজিরগণ সাধ্যানুসারে বন্দিদেরকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে আপন আপন গৃহে স্থান দিলেন এবং আত্মীয়-স্বজনের মতোই তাদের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করলেন।’ বন্দিদের স্বগতোক্তি ছিল- ‘মদিনাবাসীদিগের ওপর আল্লাহর রহমত নাজিল হোক। তারা আমাদেরকে উটে চড়তে দিয়ে নিজেরা পায়ে হেঁটে গেছেন, নিজেরা শুষ্ক খেজুর খেয়ে আমাদেরকে রুটি খেতে দিয়েছেন।’ (বিশ্বনবী, গোলাম মোস্তফা, পৃষ্ঠা ১৬০) বদরের ঐতিহাসিক যুদ্ধ দয়া-মায়া ও ক্ষমা প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। যা আমরা রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস পবিত্র রমজান থেকে শিখতে পারি। তাই মাগফিরাতের এই মাসে চার কাজ বেশি বেশি করি। ১. কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ ২. ইস্তেগফার পাঠ ৩. জান্নাত তলব ৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাওয়া। আরও দেখুন আদল ও ইনসাফ শিক্ষার অনেক বড় দিকনির্দেশনা রয়েছে এখানে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিজয়ের আনন্দের সুসংবাদ নিয়ে পালক পুত্র হজরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) ও কবি আবদুল্লাহ (রা.) কে পাঠিয়ে দিলেন। আল আকিক উপত্যকায় থেকে হজরত আবদুল্লাহ (রা.) কোবার পার্বত্য এলাকায় এবং হজরত যায়েদ বিন হারেসা (রা.) মদিনা নগরের দিকে গেলেন। হজরত যায়েদ বিন হারেসা (রা.)-এর বাহন ছিল নবীজির প্রিয় ‘আল কাছওয়া’ নামক উট। তাঁরা দ্রুত এসে মদিনায় বিজয়ের বার্তা প্রচার করলেন। পরদিন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিজয়ী বেশে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলেন। গনিমতের এক-পঞ্চমাংশ সরকারি কোষাগারে রেখে বাকি চার অংশ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে সমানভাবে বণ্টন করে দিলেন। মহান রব্বুল আলামিনের কাছে দোয়া করি, তিনি যেন বিষয়টিকে সঠিকভাবে অনুধাবন করার তৌফিক দান করেন। আমিন।

* গতকাল প্রকাশিত ‘জান্নাত লাভের অফুরন্ত সুযোগ’ এর লেখক মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী। ভুলক্রমে অন্য নাম ছাপা হওয়ায় দুঃখিত। -বা.স.

সর্বশেষ খবর