রবিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভোরের আগুনে নাশকতার গন্ধ

সাখাওয়াত কাওসার

ভোরের আগুনে নাশকতার গন্ধ

রাজধানীর নিউমার্কেটে গতকাল আগুন লাগে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

৪ থেকে ১৫ এপ্রিল। ব্যবধান মাত্র ১২ দিনের। এবার পুড়েছে রাজধানীর সব শ্রেণির মানুষের কেনাকাটার অন্যতম আস্থার ঠিকানা নিউ সুপার মার্কেট। বঙ্গবাজারে আগুনের সূত্রপাত ভোর ৬টা ১০ মিনিটে আর নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লেগেছে ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে। কাকডাকা ভোরে অনেকটা একই সময়ে দুটি জনবহুল ও জনপ্রিয় মার্কেটে ভয়ংকর আগুন লাগার কারণ নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এমন প্রলয়ঙ্করী অগ্নিকা-গুলো ভাবিয়ে তুলছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়কেও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই মার্কেটেই ক্ষতির চিত্রে অনেক মিল রয়েছে। ঈদের আগে বেচাকেনার জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নেওয়া ছিল ব্যবসায়ীদের। তবে সবকিছু ভন্ডুল করে দিয়েছে আগুন। যে কোনো মূল্যে এসব ঘটনার লাগাম টানতে না পারলে নিশ্চিতভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। অগ্নিনির্বাপণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন ফাইলবন্দিই থেকে যায় বছরের পর বছর। কমিটির সুপারিশগুলোও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আলোর মুখ দেখে না। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া এবং সুপারিশমালা বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে নাশকতাকারীরাও উৎসাহিত হয়। মিশন শেষ করে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে তারা। এদিকে সম্প্রতি দেশে ঘটে যাওয়া কয়েকটি বড় অগ্নি-দুর্ঘটনা নাশকতা হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। গতকাল রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে আইজিপি বলেন, ‘আমরা ইদানীং লক্ষ করছি রাজধানীর কয়েকটি মার্কেটে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। আগুনের প্রতিটি ঘটনা বাংলাদেশ পুলিশ খতিয়ে দেখছে। এখানে যদি কোনো নাশকতা থাকে তাহলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ বিকালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশনস) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রতিনিয়ত অপরাধের ধরনগুলো পরিবর্তন হচ্ছে। তাই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোরই উচিত হবে এসব ঘটনার কারণগুলো খতিয়ে দেখা। বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটের আগুনের ঘটনা আমাদের অনেকভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। এখন পুলিশ কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃতটা বলতে পারবেন।’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবাজারের তদন্তে সিগারেটের আগুনের বিষয়টি আসছে। আগামীকাল (রবিবার) ওই যুবককে আমরা আবারও ডেকেছি। এ ছাড়া আমাদের ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তার কিংবা অন্য উপকরণগুলো বাস্তবতার সঙ্গে কতটুকু খাপ খাচ্ছে এ বিষয়টাতে আমরা অনেকটাই উদাসীন।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ভোর ৫টা ৪৮ মিনিটে আগুন লাগে গুলশান ১ নম্বরের ডিএনসিসি মার্কেটে। এর দুই বছর পর আবার ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ একই সময়ে আগুন লাগে। দুইবারই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা নাশকতার অভিযোগ তুলেছিলেন। তখনো তাদের দাবি ছিল, প্রতিবারই ভোরে আগুন লাগে কেন। তবে তদন্তে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের বাইরে কোনো কিছুই উঠে আসেনি। এবারের বঙ্গবাজারের আগুনের তদন্তে সিগারেটের বিষয়টি উঠে এসেছে। এখনো পর্যন্ত বলা হচ্ছে হয়তো অসতর্কতা ছিল। কিছু গণমাধ্যমে বিষয়টি উঠে এলেও ক্ষতিগ্রস্তরা বিষয়টি মানতে নারাজ। এবার নিউ সুপার মার্কেটের আগুনও ফুট করিডরের কাজের সময় শর্টসার্কিট হয়েছিল বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন। তবে তাদের এ দাবি অস্বীকার করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ফায়ার বিশেষজ্ঞ ও ফায়ার সার্ভিসের সাবেক উপ-পরিচালক সেলিম নেওয়াজ বলেন, ‘নিউমার্কেটের আগুন তো আর বঙ্গবাজারের মতো নয়। এটা তো পাকা বিল্ডিং। এর পরও আগুন কেমন করে ছড়িয়েছে। আমরা সব সময়ই বলে আসছি মার্কেটগুলোতে স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে। তাতে নাশকতার চেষ্টাও ভয়ংকর রূপ নিতে পারত না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মার্কেটগুলোতে কি নিয়মিত মহড়া হয়? এটা নিশ্চিত হলেও মার্কেটগুলোতে ভলান্টিয়ার তৈরি হতো। বাইরে লোকজন আক্রমণ করেও তেমন কিছু করতে পারত না। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স নাম হলেও তাতে কি সিভিল ডিফেন্স আছে? তাহলে ওয়ার্ডেন বাহিনী কোথায় গেল?’ প্রশ্ন তার। জানা গেছে, ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের আগুনের ঘটনাটি বিদ্যুতের শর্টসার্কিট থেকেই সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করছেন ওই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট (দক্ষিণ) বণিক সমিতির সাবেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘নিরাপত্তারক্ষীরা আমাদের জানিয়েছেন, ভোর ৪টার দিকে (সাহরির সময়) সিটি করপোরেশনের একদল লোক নিউ সুপার মার্কেটের পূর্ব পাশের সিঁড়ি বিনা নোটিসে ভাঙতে আসেন। নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের অনেকবার নিষেধ করেন, সমিতির নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। অন্তত আগে বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ করে নিতে বলেন। কিন্তু সিটি করপোরেশনের লোকজন কারও কথা না শুনে সিঁড়ি ভাঙা শুরু করেন। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই হঠাৎ মার্কেটের নিচতলা ও তিনতলায় বিকট শব্দ হয় এবং ধোঁয়া বের হতে থাকে।’ ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট (দক্ষিণ) বণিক সমিতির বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব কাজী আবুল খায়েরও একই কথা জানান। তিনি মনে করেন, নিয়ম না মেনে, বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ না করে সিঁড়ি ভাঙার কারণে আগুন লাগতে পারে। গতকাল ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যবসায়ীরা বলেন, গত রমজান মাসে ওই সিঁড়ি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিল সিটি করপোরেশন। কিন্তু গত এক বছরেও তারা এ বিষয়ে কিছু করেনি। সিসিটিভি ফুটেজ দেখার দাবি জানিয়ে আরেক ব্যবসায়ী জানান, ‘সিটি করপোরেশনের লোকদের গ্যাস দিয়ে সিঁড়ির রড কাটা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। রাত ৪টা থেকে তারা কেটেছে। সিসিটিভির ফুটেজ দেখলে আপনারা প্রমাণ পাবেন।’ আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে এই আগুন লাগাইছে।’ তবে ব্যবসায়ীদের দাবির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এক বিবৃতিতে বলেছে, আগুনের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কাজের সম্পর্ক নেই। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, নিউমার্কেট-সংলগ্ন একটি পদচারী-সেতুর সঙ্গে নিউ সুপার মার্কেটের সংযোগ দাফতরিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আগুন লাগার আধঘণ্টারও আগে তাদের কাজ শেষ হয়। সেতু বিচ্ছিন্নকরণের স্থান থেকে ৪০০ ফুটেরও বেশি দূরত্বে আগুন লেগেছে এবং সেতু বিচ্ছিন্নকরণের কাজে ‘গ্যাস কাটার’ ব্যবহার করা হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তারা বলছেন, পাঁচ মাস আগে তারা খবর পেয়েছিলেন, সরকারবিরোধী সিন্ডিকেটটি নাশকতার সব পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তারা সরকারদলীয় কর্মকর্তাদের হয় ম্যানেজ করে, নয় তো তাদের উদাসীনতার সুযোগ নেয়। বঙ্গবাজারের আগুনটিকে তারা এখনো নাশকতাই মনে করছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর