বৃহস্পতিবার, ৪ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্বপ্নের ফাঁদে ফেলে নারীদের বিক্রি

মাহবুব মমতাজী

স্বপ্নের ফাঁদে ফেলে নারীদের বিক্রি
পুলিশ সদর দফতরের সারা দেশের মানব পাচার মামলার পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০৪ সালের ১৫ জুন থেকে গত বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত পাচারের শিকার হয়েছেন ১৩ হাজার ৪২৪ জন। উদ্ধার হয়েছেন ১০ হাজার ৫৭৯ জন। দুই হাজার ৮৪৫ জনের কোনো খোঁজ মেলেনি

ভালো কাজের স্বপ্নের ফাঁদে পড়ে পাচার হয়েছেন অসংখ্য নারী। তাদের মধ্যপ্রাচ্যের ওমানে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাচার হওয়া নারীর সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও ভুক্তভোগীরা বলছেন, তাদের মতো ওমানে পাচারের শিকার নারী ১০ হাজারের বেশি হবেন। বেশির ভাগের ঠাঁই হয়েছে পতিতালয়ে।

এমনি একজন ভুক্তভোগী সেঁজুতি (ছদ্মনাম)। বয়স ৩৬। বাড়ি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ধলপুরে। এক বছরেরও বেশি সময় আগে টিকটক করতে গিয়ে ফেসবুকে পরিচয় হয় ওমান প্রবাসী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। একপর্যায়ে প্রেমের সম্পর্ক হয় তাদের। কিন্তু রফিকুল যে তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়েছেন, তা বুঝতে পারেননি তিনি। আবার এনজিওর আড়ালে সেঁজুতির মতো ওমানে পাচার হন রামপুরার মমিনাও (ছদ্মনাম)।

শুধু ওমানে নারী পাচারের ঘটনাটিই নয়, উচ্চ বেতনে ভারতেও বিভিন্ন বয়সী নারী পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে।

মানব পাচার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি একটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাচার হওয়া অন্তত ৬৪৩ জনকে তারা ভারত থেকে ফিরিয়ে এনেছেন।

এই প্রতিবেদককে সেঁজুতি জানান, ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে একাই চলে যান ওমানে রফিকুলের কাছে। বিমানবন্দর থেকে আলখুর নামে একটি স্থানের বাসায় নিয়ে যান। সেখানে তাকে ধর্ষণ করেন। এরপর রফিকুল তার বাসায় কালাম, কাজী ও জিলানী নামে তিনজনকে ডেকে আনেন। রফিকুল তাদের সঙ্গে সেঁজুতিকে যেতে বলেন এবং জানান- তারা তাকে হাসপাতালে কাজ দেবেন। তারা তাকে ওমানের ছিববাজার নামে একটি স্থানে একটি ঘরে নিয়ে রাখেন। এরপর দেহব্যবসায় বাধ্য করান। ওমানে অবস্থান করা এক প্রবাসীর মাধ্যমে জানা যায়, ওমানের দক্ষিণ পূর্বদিকে সালালাহ, আর সালালাহর এক গ্রামের নাম ছিববাজার। সমুদ্র পাড়ের এই গ্রামটি পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এখানে বিভিন্ন বাড়িতে ছোট ছোট আকারে পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেছে পতিতালয়।

২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর সেঁজুতি দেশে ফিরে আসেন। ২০১৯ সালে পাচার হওয়া ওমান থেকে ফিরে আসেন আরও দুই নারী। তাদের অভিযোগ, তাদের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কথা বলে ওমানে নেওয়া হলেও কাজ করতে হতো বিভিন্ন বাসায়। বাসায় কাজ করতে না পারলে বা যৌনকাজে রাজি না হলে অফিসে এনে লাইন করে দাঁড় করানো হতো। তারপর মালিকেরা গরুকে যেভাবে পছন্দ করে অনেকটা সেই রকম পদ্ধতিতে পছন্দ করতেন। এভাবে হাতবদল হতে হয় একাধিকবার। পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সিরিয়াস ক্রাইমে যোগাযোগ করলে গত বছরের ৩১ মার্চ যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা করেন সেঁজুতি।

এনজিওর আড়ালে পাচার : ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর রাজধানীর রামপুরা থানায় মামলা করেন মমিনা (ছদ্মনাম) নামের এক নারী। তার বয়স ৪৫। এ মামলায় রবি, কাশি ও মিলি ছাড়াও অজ্ঞাত আরও ৩-৪ জনকে আসামি করা হয়। এদের মধ্যে রুবি নিজেকে বাংলাদেশি মাইগ্রেন্ট ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন নামে একটি এনজিওকর্মীর পরিচয় দিতেন। ওই এনজিওর আড়ালেই তিনি অন্তত ২০ নারীকে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন একই এনজিওর কর্মী দাবি করা আরেকজন। ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন সিআইডির তৎকালীন পরিদর্শক মো. রাসেল। মামলার কাগজপত্র থেকে জানা যায়, মমিনা রামপুরা এলাকার বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কাজ করতেন। রুবি তাকে ভালো চাকরির প্রলোভনে ২০১৫ সালের ১৮ মে দুবাইয়ে পাঠান। বিমানবন্দর থেকে এক ব্যক্তি তাকে রিসিভ করে অজ্ঞাত স্থানে ১০ দিন তালাবদ্ধ করে রাখেন। সেখানে তাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। সেখান থেকে দালালের মাধ্যমে ওমানে পাচার করা হয়। তার সঙ্গে আরও ২০-২৫ জন বাংলাদেশি নারীকে ওমানে পাচার করা হয়।

মা পাঠাতেন ভিসা, ছেলে পাঠাতেন নারী : মানব পাচারের অভিযোগে গত বছরের ১০ আগস্ট দুজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৩। এরা হলেন- জাবেদ হোসেন রকি (৩৩) ও আবির হোসেন ওরফে শুভ (২৭)। র‌্যাব জানায়, ২০০৪ সাল থেকে ওমানে থাকেন সেলিনা রহমান ওরফে রোকেয়া। সেখানে স্থানীয় একটি রিক্রুটিং এজেন্সিতে কাজ করার পরিপ্রেক্ষিতে গত চার বছর ধরে ভিসা পাঠিয়ে প্রায় অর্ধশত নারীকে ওমান নিয়ে গেছেন তিনি। দেশ থেকে নারীকর্মী খোঁজা এবং এ কাজে রোকেয়াকে সহায়তা করে আসছিলেন ছেলে জাবেদ ও তার সহযোগী আবির। রোকেয়া ওমান থেকে ভিসা পাঠাতেন আর বাংলাদেশ থেকে নারীদের বিদেশ পাঠাত ছেলে জাবেদ।

আশুলিয়া থেকে নিখোঁজ তরুণী গুজরাটের জেলে : ঢাকার আশুলিয়াতে একটি গার্মেন্টে চাকরি করতেন ২১ বছর বয়সী এক তরুণী। তার বাড়ি রাজবাড়ী জেলায়। গত বছরের ১১ এপ্রিল হঠাৎ নিখোঁজ হন ওই তরুণী। মেয়ের কোনো খোঁজ না পেয়ে আশুলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ওই তরুণীর বাবা আকতার সরদার। জিডির সূত্র ধরে ওই তরুণীর স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এ প্রতিবেদকের। আশুলিয়া থানা পুলিশও তার কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। হঠাৎ একদিন এক ভারতীয় মোবাইল নম্বর থেকে ফোন আসে ওই তরুণীর বাবার কাছে। সেই ফোন নম্বরের সূত্র ধরে খোঁজ মেলে ওই তরুণীর। জানা যায়, মেয়েটি গুজরাটের লাস্টপুর সেন্ট্রাল জেলে আটক আছেন। আশুলিয়া থানার এসআই জোহাব আলী চিঠি দিয়ে গত বছরের ১৭ মে পুলিশ সদর দফতরের এনসিবি শাখার মাধ্যমে ওই মেয়েটির বিস্তারিত জানতে ভারতে যোগাযোগ করে। এক মাস পর মেয়েটির বাবাও গুজরাটে চলে যান মেয়ের খোঁজে।

জেলে মেয়ের সঙ্গে কথা বলে জানান যে, ফেসবুকে ভারতে অবস্থান করা ফারজানা নামে এক নারীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর ইমুতে কথা হতো। উচ্চ বেতনে ভারতে চাকরির প্রলোভন দেন ফারজানা। ফারজানা ঢাকায় অবস্থান করা নয়ন ও ফাতেমা নামে দুজনের সঙ্গে ওই তরুণীকে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে ওই তরুণী পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে তাদের সঙ্গে নবীনগরে বাসে উঠে যশোর চলে যান। সেখানে আগে থেকে ঠিক করে রাখা দালালের মাধ্যমে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নিমতলীতে চলে যান। সেখান থেকে কলকাতার হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ধরে গুজরাটের উদ্দেশে রওনা দেন। তিন দিন যাত্রার পর গুজরাট পৌঁছান। সেখানে যাওয়ার পর একটি বাসায় তাকে আটকে রেখে দেহব্যবসায় বাধ্য করানো হতো। তিন দিন পর কৌশলে ওই নারী পালিয়ে গুজরাটের সুরাত রেলওয়ে পুলিশ স্টেশনে আশ্রয় নেন। ওই থানা পুলিশ তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে জেলে আটকে রাখে। ওই তরুণীর ভাই রবিউলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে তার বোনকে তারা চলতি বছরের শুরুতে দেশে ফিরিয়ে এনেছেন। এসআই জোহাব আলী এ প্রতিবেদককে বলেন, ওই তরুণী ফিরে এসেছেন। কিন্তু তার স্বজনরা পরে কোনো মামলা করেননি। তাই আর পাচারকারীদেরও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

খোঁজ নেই পাচার হওয়া দুই হাজারের : দালালদের ছলচাতুরীর লোভে পড়ে বাংলাদেশের বহু নারী পাচার হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, পাচার হওয়ার কারণে তাদের সবার জীবনে ভয়ানক দুর্ভোগ নেমে এসেছে। গত ১৮ বছরে পাচার হওয়া দুই হাজারের বেশি মানুষের খোঁজ এখনো মেলেনি। এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক পুরুষও আছেন। তবে বেশির ভাগই নারী ও শিশু। পুলিশ সদর দফতরের সারা দেশের মানব পাচার মামলার পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০৪ সালের ১৫ জুন থেকে গত বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত পাচারের শিকার হয়েছেন ১৩ হাজার ৪২৪ জন। উদ্ধার হয়েছেন ১০ হাজার ৫৭৯ জন। দুই হাজার ৮৪৫ জনের কোনো খোঁজ মেলেনি। এদিকে সিআইডি সূত্র জানায়, রিয়া ও তার এক বান্ধবী নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লায় একটি টেইলারিং দোকানে কাজ করতেন। সেখানে এক নারীর সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। ওই নারী তাদের ভালো বেতনে ভারতে টেইলারিংয়ের কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। সেই প্রলোভনে পড়ে ওই দুই তরুণী ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি সাতক্ষীরা সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যান। এরপর তাদের মুম্বাইয়ে পাঠানো হয়। সেই থেকে তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

এই ঘটনায় ওই দুই তরুণীর একজনের খালা ওই বছরের ২১ মার্চ নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লা থানায় মানব পাচার আইনে মামলা করেন। এ মামলার সূত্র ধরে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর ফতুল্লার কাশিপুর থেকে কানিজ ফাতেমা (৪০) নামে এক নারীকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তার দেওয়া তথ্য মতে, গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর যশোরের কেশবপুর থেকে আবদুস সাত্তার নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি তার জবানবন্দিতে জানিয়েছেন- পাচার হওয়া ভুক্তভোগীদের তিনি মোটরসাইকেলে করে যশোর থেকে সাতক্ষীরায় মোকলেছুর রহমানের বাড়িতে রেখে আসেন। পরে ভারতে অবস্থান করা নজরুল ও তার সহযোগীদের সহায়তায় সেদেশে পাচার করে দেন।

এ চক্রের হোতা আনোয়ার হোসেন ভারতের কারাগারে আটক আছেন।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) যশোর জেলা সূত্র জানায়, যশোর কোতোয়ালির শেখহাটি জামরুলতলা গ্রামের এক ব্যক্তির স্ত্রীকে ভারতে পাচার করা হয়। একই বাড়িতে ভাড়া থাকার সুবাদে মজনু বিশ্বাস ও তার স্ত্রী মাজেদা খাতুনের সঙ্গে ওই গৃহবধূর সখ্য গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে তাকে ভারতে নিয়ে ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখান। গত বছরের ১৭ মে বিকালে তাকে চৌগাছা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে সুরাতে নিয়া যান। সেখানে আগে থেকে থাকা মজনু বিশ্বাসের চাচাতো শ্যালক সোহাগ সরদারের কাছে বিক্রি করে দেন। সেখানে সোহাগ সরদার ও তার স্ত্রী মিম বেগম ওরফে জয়া ওরফে রিয়া বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওই গৃহবধূকে জোর করে অনৈতিক কাজে লিপ্ত করান। চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পাচার হওয়া ওই গৃহবধূকে ভারত থেকে উদ্ধার করা হয়।

সর্বশেষ খবর