বৃহস্পতিবার, ১৮ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

কোথাও বাড়তি সুবিধা পান না বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতরা

গাড়িতে পতাকা ওড়ানোর নিয়মও একেক দেশে একেক রকম

জুলকার নাইন

বাংলাদেশে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা যেমন বিশেষ নিরাপত্তাসহ বিশেষ বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকেন বিশ্বের কোথাও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতরা এমন কোনো সুবিধা পান না। চলাচলে পুলিশি গাড়ির বহর তো দূরের কথা ব্যক্তি নিরাপত্তার জন্য পুলিশও থাকে না। কিছু দেশে পারলেও বেশ কয়েকটি দেশে রাষ্ট্রদূতরা গাড়িতে পতাকাও ওড়াতে পারেন না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের বর্তমান ও সাবেক রাষ্ট্রদূতরা বলছেন, কূটনীতিকরা কেমন সুযোগ-সুবিধা পাবেন এটা পুরোপুরিই নির্ভর করে হোস্ট কান্ট্রির সিদ্ধান্তের ওপর। আর সুযোগ-সুবিধা সাধারণত সবার জন্যই সমান হয়ে থাকে, কমবেশি হওয়ার সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করে আসা সাবেক পেশাদার কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় প্রত্যেক স্বাগতিক দেশ (হোস্ট কান্ট্রি) তার দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় সেখানে কর্মরত কূটনীতিক ও কূটনৈতিক স্থাপনার নিরাপত্তা বিধান করে। এটা কোন দেশে কেমন হবে তার কোনো স্থায়ী কাঠামো নেই। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার মতো করে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা বিধান করে। শুধু বাংলাদেশ নয়, কোনো দেশের জন্যই বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার বা চাওয়ার কোনো কালচারই নেই। যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূতদের বাড়িতে ও অফিসে পতাকা ওড়ানো হয় কিন্তু গাড়িতে কোনো রকমের পতাকা ওড়ানো হয় না। কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতই পতাকা ওড়ান না। তবে গাড়ির নম্বর প্লেট ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে, এটা দেখে তারা বুঝতে পারেন এটা কোন দেশের রাষ্ট্রদূতের। অন্যান্য দেশে নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে হুমায়ুন কবির জানান, নেপালে রাষ্ট্রদূতদের বাড়িতে ও দূতাবাসে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ থাকে। গাড়িতে কোনো পুলিশ থাকে না, তবে গাড়িতে পতাকা ওড়ানো হয়। ভারতেও একই অবস্থা, গাড়িতে পতাকা ওড়ানো যায় তবে বাড়তি নিরাপত্তা থাকে না। তবে কলকাতায় দায়িত্ব পালনের সময় গাড়িতে সামনে একজন গানম্যান বসতেন। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে ও দূতাবাসে পতাকা ওড়ানো হয় কিন্তু বাড়তি কোনো নিরাপত্তা থাকে না। প্রবীণ কূটনীতিক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইতালিতে দায়িত্ব পালনের সময় ইতালির একজন সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাফিয়াদের দ্বারা খুন হয়েছিলেন। খবর পাওয়ার পর আমরা সব দেশের রাষ্ট্রদূতরা ভয়ে বাসায় বসেছিলাম। পরে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলে তারা পুলিশ প্রহরায় দূতাবাসে নিয়েছিল। কিন্তু সেটাও ছিল মাত্র দুই দিন। স্থায়ী কোনো পুলিশি নিরাপত্তা ছিল না। ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে ওয়ালিউর রহমান বলেন, ইন্দোনেশিয়ায় তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে থাকা এক সেনা কর্মকর্তা তখন স্থায়ী নিরাপত্তার জন্য সে দেশের সঙ্গে বেশ হইচই করেছিলেন। কিন্তু স্থায়ী কিছু তারা দেয়নি। তারা বলেছিল চাইলে দেওয়া হবে, স্থায়ী কিছু হবে না। বরং এক শহর থেকে আরেক শহরে যাওয়ার সময় নিরাপত্তা চাইলে টাকার বিনিময়ে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হতো। রাষ্ট্রদূতদের গাড়িতে পতাকা ব্যবহার প্রসঙ্গে ওয়ালিউর রহমান বলেন, ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে প্রত্যেক দেশেই রাষ্ট্রদূতরা গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা গায়ের জোরেই তাদের দেশে পতাকা ব্যবহার করতে দেয় না। তারা তাদের প্রেসিডেন্ট ছাড়া কারও গাড়িতে পতাকা রাখতে দিতে ইচ্ছুক নয়, সবাই তাদের এই ইচ্ছাকে সম্মান করে। সাবেক রাষ্ট্রদূত সোহরাব হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ স্বাগতিক দেশ হিসেবে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের যে নিরাপত্তা দেয় তা আর কোথাও দেখিনি। কখনো কোথাও আমি বিশেষ এসকোর্ট পাইনি, পশ্চিমা দেশে গাড়িতে পতাকা ওড়ানো যেত না। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত বাংলাদেশের দূতাবাসের বাইরে বা রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে কোনো নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরা থাকে না। বাড়তি নিরাপত্তারক্ষী বা গানম্যান থাকা দূরের কথা, গাড়িতে শুধু চালক ও কূটনীতিক থাকেন। বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সব দেশের সরকারের একটি স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল আছে। কোনো দেশের কূটনীতিক স্বাগতিক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফোন দিয়ে তাদের চলাচলের কথা জানালে পররাষ্ট্র দফতর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো বাড়তি নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয় না। তবে টাকার বিনিময়ে নিরাপত্তা প্রটোকল পাওয়া যায়। পাকিস্তানে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রদূত সোহরাব হোসেন বলেন, কূটনীতিকদের কেমন নিরাপত্তা দেওয়া হবে সেটা স্বাগতিক দেশের ওপর নির্ভর করে। যেমন আফগানিস্তান, পাকিস্তানে কিছুটা নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে। আবার রাজধানীর বাইরে গেলে ঝুঁকি বাড়তে পারে। একবার আমি ইসলামাবাদ থেকে আরেক শহরে যাওয়ার আগে নিরাপত্তা চেয়েছিলাম। কিন্তু এ জন্য আমার কাছে অর্থ দাবি করা হয়। তখন আর নেইনি। জানা যায়, ঢাকায় কূটনৈতিক জোনে ৫৩টি দেশ রয়েছে। প্রতিটি দেশের কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দিতে বিশাল সংখ্যক নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন থাকে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, সৌদি আরবের ক্লাব, দূতাবাস, বাসভবনসহ কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় ৪৮ জন পুলিশ মোতায়েন আছে। ব্রিটিশ হাইকমিশনের নিরাপত্তায় ২৯ জন দায়িত্ব পালন করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ১৫৮ জন নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছেন। তাদের এসব নিরাপত্তা অব্যাহত থাকবে। শুধু ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে পুলিশের বাড়তি সুবিধা প্রত্যাহার হবে বলেন শাহরিয়ার আলম। অন্যদিকে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডে কখনোই পতাকা ওড়ানোর কোনো পদ্ধতি নেই। অনেক দেশে আছে, রাষ্ট্রীয় যত মিটিং হয় তখন পতাকা উড়িয়ে যাওয়া যায়। এটা মিশন প্রধানদের নিজেদের ওপর থাকে। আনুষ্ঠানিক বৈঠকে পতাকা উড়িয়ে যেতেই পারেন কিন্তু অনানুষ্ঠানিক দাওয়াত বা ব্যক্তিগত কাজে পতাকা উড়িয়ে যাওয়াটা রাষ্ট্রদূতদের নিজেদের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূতদের পতাকা ওড়ানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর