শুক্রবার, ১৯ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

আত্মসমর্পণকারীরা ফের মাদকে

♦ জব্দ করা আলিশান প্রাসাদগুলো জমজমাট ♦ ইয়াবা আইস কারবারে নতুন গডফাদার

মির্জা মেহেদী তমাল, কক্সবাজার থেকে ফিরে

আত্মসমর্পণকারীরা ফের মাদকে

কক্সবাজারের টেকনাফের মাদক মাফিয়া নূরুল হুদা মেম্বার। লেদায় তার গ্রামের বাড়ি। হ্নীলায় তার আলিশান প্রাসাদ রয়েছে। ২০১৯ সালে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলে অন্য মাদক কারবারিদের সঙ্গে নূরুল হুদাও আত্মগোপনে যান। এ সময় পুলিশ তার সেই রাজপ্রাসাদে বুলডোজার চালায়। সামনের অংশ গুঁড়িয়ে দেয়। এ সময় সরকার ক্ষমা ঘোষণা করলে আত্মগোপনে থাকা ১০২ জন মাদক মাফিয়া আত্মসমর্পণ করেন। সেই ১০২ জন আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে নুরুল হুদা মেম্বারও ছিলেন। কিন্তু বেশি দিন জেলখানায় আটকে থাকতে হয়নি নুরুল হুদাকে। শরীর থেকে মাদক কারবারির কালিমা ধুয়ে-মুছে বুক চিতিয়ে জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর আবারও তিনি মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ভেঙে ফেলা তার প্রাসাদে সংস্কার করেছেন। প্রাসাদটি তার আবারও আগের মতোই হয়ে উঠেছে। হ্নীলা ইউনিয়নে ঢুকতে রাস্তার ঠিক মাথায় গোলাপি ও টিয়া রঙের রাজপ্রাসাদ দুটি আবারও চোখে পড়ছে। বাড়ির নিরাপত্তায় আবারও রক্ষী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা নি-িদ্র করতে বাড়ির চারপাশে লাগানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। আর মাদক কারবার! আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি তৎপর শুরু করেছে মাদক কারবারে। তিনি এখন পুরোদস্তর মাদক কারবারি। শুধু নুরুল হুদাই নন, অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১০২ মাদক কারবারির মধ্যে অন্তত ৭৫ জন ফিরেছেন মাদক কারবারে। ‘রাজপ্রাসাদে’ ফিরতে শুরু করেছেন টেকনাফের ইয়াবা ‘রাজা’রা। আবারও আলো ঝলমল হয়ে উঠেছে এসব বাড়ি। ফিরেছে সেই জৌলুস। শুধু তাই নয়, এরাই গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১০২ জনের মধ্যে ডেইলপাড়ার আবদুল আমিন, নুরুল আমিন, এনামুল হক, সাহেদ কামাল, মোজাম্মেল হক, জুবায়ের হোসেন, নুরুল বশর, কামরুল হাসান, আবদুর রহমান, নুরুল কবি, মো. জামাল, হাবিবুর রহমান, শামসুল আলম, আবদুল গনি, মোহাম্মদ আলী, মো. সিরাজ, মো, তৈয়ব, আশ আজম, জাফর আহমেদ, নুরুল আলম, আবু তৈয়ব, আলী নেওয়াজ, জহুর আলম, হুসাইন, ছিদ্দিক, রবিউল আলম, মঞ্জুর আলী, হামিদ হোসেন, মো. আলম, আইয়ুব আলী, নুরুল আমিন, বোরহান উদ্দিন, ইমান হোসেন, রহিমউল্লাহ, মো. রফিক, মো. হেলাল, বদিউর রহমান, আবদুল কুদ্দুস, আলী আহম্মেদসহ ৭৫ জন মাদক কারবারে ফিরে গেছেন। এদের মধ্যে ২০ জনের রাজপ্রাসাদ ফের সংস্কার করা হয়েছে। প্রাসাদগুলো এখন জমজমাট। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই মেরিন ড্রাইভে মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যাকান্ডের পর সব মাদক ব্যবসায়ীর প্রতীক্ষার অবসান হয়।

টেকনাফ থানা থেকে ২-৩ কিলোমিটার দূরে নাজিরপাড়া। ওই এলাকায় ইয়াবা কারবারের টাকায় গড়ে তোলা হয়েছে সাতটি প্রাসাদোপম বাড়ি। বিলাসবহুল দুটি বাড়িতে থাকতেন নুরুল হক ভুট্টো ও তার ভাই নুর মোহাম্মদের পরিবার। তবে আদালতের নির্দেশে আলোচিত ইয়াবা কারবারি নুরুল হক ভুট্টোর দুটি দোতলা বাড়িসহ প্রায় ৩১ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করেছিল পুলিশ। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মামলায় এ আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। পুলিশ দোতলা দুটি বাসভবন এবং ১১টি স্থানে থাকা প্রায় ২০ একর জমি জব্দ করেছিল। এর পর থেকে বাড়ি দুটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন এপিবিএন পুলিশ সদস্যরা। তবে এ বাড়ি দুটি টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি বর্তমানে কারাগারে আটক প্রদীপ সাহা টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতেন। মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যার ঘটনার পর পুলিশ সদস্যরা ওই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তবে বাস্তবতা হলো, বর্তমানে ওই বাড়িতেই বসবাস করছে ভুট্টোর পরিবার। ২০১৯ সালের মার্চে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নুরুল হক বুট্টোর ভাই নুর মোহাম্মদ নিহত হন।

২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ও ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াবা এবং অস্ত্র তুলে দিয়ে টেকনাফের প্রথম দফায় শীর্ষ ১০২ জন, দ্বিতীয় দফায় ২১ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করলেও ভুট্টো আত্মসমর্পণ করেননি।

টেকনাফ দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার ইয়াবা কারবারি মো. জুবায়েরের তিন তলা বাড়িটির বাইরে থেকেই চোখ-ধাঁধানো। অথচ বাড়িটির আশপাশের সবকটিই ভাঙা বেড়ার ঘর, ওপরের ছাউনি পলিথিনের। এখানকার নিম্ন আয়ের সব মানুষই দিনমজুর অথবা জেলে। জুবায়ের একসময় ছিঁচকে চোর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরে ইয়াবা কারবারি হয়ে রাতারাতি কোটিপতি বনে যান। সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, জুবায়েরের বাড়ির ভিতরটা খুবই জৌলুসপূর্ণ রাজধানীতেও যা সচরাচর চোখে পড়ে না। এ বাড়ির কাছেই আরেকটি ডুপ্লেক্স বাড়ির মালিকের নাম মোজাম্মেল। যিনি একসময় পৌরসভার লামার বাজারে একটি পলিথিনের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। অভিযান শুরুর পর তারা সবাই আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। টেকনাফের শুধু হ্নীলা কিংবা পৌরসভার জালিয়াপাড়া নয়, সদর ইউনিয়ন, সাবরাং ইউনিয়ন, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়ায় গড়ে উঠেছে রাজপ্রাসাদের মতো অর্ধশতাধিক বাড়ি। এসব বাড়িতে ব্যবহার করা হয়েছে বিদেশি মারবেল পাথর, উন্নতমানের টাইলস ও ফিটিংস। বাড়িগুলোর বাইরের দৃশ্য এতটাই দৃষ্টিনন্দন যে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বাড়ির ভিতরের প্রতিটি কক্ষ সাজানো বিদেশি আসবাবপত্র ও সামগ্রী দিয়ে। স্থানীয়রা বলছেন, কয়েক বছর আগেও এদের কেউ ছিলেন বেকার, কৃষক, কেউ গরু ব্যবসায়ী, কেউ বাসের হেলপার, কেউবা বিক্রি করতেন পিঠা। কিন্তু ইয়াবা নামের আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়ায় তাদের কপালে লেগেছে রাজটীকা। ২০১৮ সালের মে মাসে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলে এসব আলিশান বাড়ির দিকে নজর পড়ে প্রশাসনের। ওই বছরের অক্টোবরে এসব বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল প্রশাসন। রাতের আঁধারে অনেক প্রাসাদোপম বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়াও হয়েছিল। তবে বাড়িগুলোতে আবারও জৌলুস ফিরে এসেছে।

দেশের ১ নম্বর শীর্ষ ইয়াবা কারবারি হাজী সাইফুল করিমের বিলাসবহুল বাড়িটি বুলডোজার দিয়ে আংশিক ভেঙে ফেলা হয়। ২০১৯ সালের ২৬ জুন টেকনাফ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদের বাড়িতে গায়েবি হামলা ঘটে। টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদ এবং তার তিন ছেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি। গত পাঁচ বছরে তিনি নির্মাণ করেছেন একটি বড় আয়তনের বাড়িসহ তিনটি বাড়ি এবং টেকনাফ শহরে একটি তিন তলা মার্কেট। অভিযান শুরুর পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। সিনহা হত্যাকান্ডের কিছুদিন পরই তিনি জামিন নিয়ে পুনরায় প্রকাশ্যে আসেন। টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মৌলভী রফিক উদ্দিন ও তার ভাই বাহারছড়া ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিনও তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি। বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুরানপাড়া গ্রামে তারা নির্মাণ করেছেন দুটি বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি। মাদকবিরোধী অভিযানের সময় এ দুই ভাই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। তারা দুই ভাই তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি হলেও এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। সাবরাং ইউনিয়নের নয়াপাড়ার সাবেক ইউপি সদস্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি মাহমুদুর রহমানের বাড়িটি চোখ-ধাঁধানো। টেকনাফ উপজেলা ভূমি অফিসের পাশেই তিনি গড়ে তুলেছেন তিন তলা মার্কেট। সাবরাংয়ের মাদক ও সোনা চোরাকারবারি মাহমুদুল হক ওরফে মাদুরানও করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, করেছেন মার্কেট। মাদকবিরোধী অভিযানের সময় পালিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। মেজর সিনহা হত্যার পর আবারও এলাকায় এসে পুরোদমে মাদকের কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া হোয়াইক্যং ইউনিয়নের নয়াবাজার সাতঘরিয়াপাড়ার সাবেক ইউপি সদস্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি রাকিব আহমদের বাড়িটিও বিলাসবহুল। মাদকবিরোধী অভিযানের সময় আত্মগোপনে ছিলেন। তার পাশাপাশি হোয়াইক্যং সাতঘরিয়াপাড়ার রোহিঙ্গা মাদক কারবারি নুর হাফেজেরও বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। টেকনাফ পৌর এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হক, মং অং থেইন ওরফে মমচিং, নুরুল বশর নুরশাদ, মো. সালমান, মো. রাসেলের রয়েছে রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি। তাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে থানায় হত্যা, অস্ত্র ও মাদক ইয়াবার মামলা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বছর ছয়েক আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকায় কক্সবাজার ও টেকনাফে ১ হাজার ১৫১ জন মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। তার মধ্যে ৭৩ জন শীর্ষ মাদক কারবারির পৃষ্ঠপোষকের নাম উঠে এসেছে। টেকনাফ ও কক্সবাজার অঞ্চলের আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের নেতাদেরও নাম আছে তালিকায়। প্রত্যেক কারবারি অঢেল সম্পদের মালিক বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। এলাকায় আছে তাদের বড় বড় অট্টালিকা। তা ছাড়া চট্টগ্রাম ও ঢাকায়ও কারও কারও আছে ফ্ল্যাট-বাড়ি। আবার কেউ দুবাই, সৌদি আরব ও মিয়ানমারেও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। পুলিশ ও র‌্যাবের কঠোর অভিযানে দিশাহারা হয়ে পড়েন কারবারিরা। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকে চলে যান আত্মগোপনে। কেউ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। আবার কেউ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে ১০২ জন মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করেন। এর কিছুদিন পর আরও ২১ কারবারি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। টেকনাফের মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, শীলবনিয়াপাড়া, মিঠাপানিরছড়া, লম্বরিপাড়া, জালিয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপসহ কয়েকটি স্থানে আছে কারবারিদের আলিশান ঘরবাড়ি।

 

সর্বশেষ খবর