প্রস্তাবিত বাজেটের টার্গেট বা লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবতা বিবর্জিত বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, বাজেটে মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেই। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। আয় বৈষম্য নিরসনে পদক্ষেপ নেই। নতুন করদাতা তৈরির পদক্ষেপ নেই। বিশাল রাজস্ব আয়ের টার্গেট।
ফলে প্রস্তাবিত রাজস্ব আয়ের টার্গেট অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলাপকালে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব কথা বলেন প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তার মতে, সামগ্রিকভাবে বাজেটের আকার মোটেই বড় নয়। জিডিপির আনুপাতিক হারে বাজেট ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। এটি পৃথিবীর অন্যতম সর্বনিম্ন। কিন্তু আকার ছোট হলেও বাস্তবায়ন বড় সমস্যা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাড়লেও ১০ মাসে বাস্তবায়ন ৫০ শতাংশের কিছুটা বেশি। এ অবস্থায় এডিপির আকার বাড়ানো হয়েছে। ফলে এটি কতটুকু বাস্তবায়ন হবে, তা সন্দেহ রয়েছে। রাজস্ব আহরণে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ।
অভিজ্ঞ এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বাজেট ঘাটতি জিডিপির পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ। এটি আরও বাড়লেও কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু ঘাটতি অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো হয়েছে। এটি ভালো পদক্ষেপ নয়। তবে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার নিচে রয়েছে। ফলে সরকার ব্যাংক থেকে এত ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। বাজেটে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর যে লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে, তা পূরণ হবে না। জিডিপির ২৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ বিনিয়োগের আশা অবাস্তব। কারণ, কয়েক বছর ধরে জিডিপির ২২ থেকে ২৩ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ হয়নি। এর মধ্যে এবার কীভাবে ২৭ শতাংশ হবে। এটি উচ্চাভিলাষী। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এটিও অবাস্তব। কারণ, এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। ফলে মূল্যস্ফীতি কমার খুব একটা লক্ষণ দেখছি না। রাজস্ব আয় প্রসঙ্গে ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রেও আমাদের চরম ব্যর্থতা রয়েছে। তারপরও প্রতি বছরই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। এবারও রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে বাজেটে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। বড় রকমের কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। এসব সমস্যা দূরীকরণে এবারের বাজেটে তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দক্ষতা বাড়াতে হবে। কিন্তু প্রতি বছর দেখা যায়, আয়-ব্যয়ের যে লক্ষ্য থাকে, সংশোধিত বাজেটে তার চেয়ে কমানো হয়। বাস্তবায়ন হয় আরও কম। বর্তমানে যে পরিমাণ টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) রয়েছে, কর দেয় এর চেয়ে অনেক কম। এক্ষেত্রে টিআইএনধারীদের কর নিশ্চিত করতে হবে। ভ্যাটের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দোকানদাররা ভ্যাট দিতে চান না। অনেক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেই। ক্রেতারাও রসিদ নিতে আগ্রহী নন। এ ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন। ইতোমধ্যে তারা করের আওতায় এসেছেন। তাদের কর নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ করের হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়াতে হবে।
সাবেক এ অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বাজেটে যে বড় আকারের ঘাটতি, সেটা মেটাতে ব্যাংকের ওপরই নির্ভর করছে সরকার। এক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে বড় ধাক্কা আসবে। অর্থাৎ বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণ পাবে না। আর যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় তাহলে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে। তার মতে, সরকার ব্যাংক থেকে অনেক বেশি ঋণ নিচ্ছে। এতে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়।