সোমবার, ৫ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বড় বিপদে শিল্প খাত

গ্যাস বিদ্যুৎ তেল সংকটে উৎপাদন কমেছে ৪০-৫০ শতাংশ, চুরি বন্ধের তাগিদ

রুহুল আমিন রাসেল

দেশের শিল্প-কারখানাগুলোয় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ উৎপাদন কমে যাওয়ার তথ্য দিয়েছেন শিল্পমালিকরা। তাদের ভাষ্য, সামনে জাতীয় নির্বাচন। এমন সময় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট। এ সংকটের প্রভাব পড়েছে শিল্প খাতে। সংকট উত্তরণে গ্যাস-বিদ্যুতের চুরি বন্ধের তাগিদ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর তেল আমদানিতে অতীতের লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার চিন্তা এখন বাদ দিতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্র বলছে, সারা দেশের শিল্প-কারখানাগুলো এখন দিনে গড়ে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। যা পায় তাও নিরবচ্ছিন্ন নয়। ফলে কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমে গেছে। বড় কারখানাগুলো সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি উৎপাদন করতে পারছে না। গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ও আবাসিক গ্রাহকরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। গ্যাস সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং চলছে। ডলারের অভাবে কয়লা ও এলএনজি আমদানি সংকটের মুখে পড়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অর্থনীতিতে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো অপরিশোধিত তেল সংগ্রহ এবং জ্বালানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি। ডলার সংকট ও বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগ, আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, রিজার্ভ সবকিছুর গতি নিম্নমুখী। অথচ মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। সরকারকে এ বাজেট মেয়াদে জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। সেখানে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সঙ্গে অনেক কিছুই জড়িত। জ্বালানির দাম বাড়লে সব পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ পাওয়া না গেলে উৎপাদন বিঘিœত হবে। ফলে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম একসময় খুব কম ছিল। আজ কিন্তু সে অবস্থা নেই। এখন বিদ্যুৎ-গ্যাসের অনেক দাম। বিদ্যুৎ-গ্যাসে আরও নানাভাবে ছাড় দেওয়া যেতে পারে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলেই শিল্পায়ন হবে। নতুন কর্মসংস্থান হবে। শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, শিল্প-কারখানাগুলোয় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ উৎপাদন কমেছে। কারখানাগুলো এখন লোকসান গুনছে। সবারই উৎপাদন খরচ বেড়েছে। অনেক শিল্প-কারখানা নতুন করে ঋণখেলাপি হবে। আসছে জুলাই ও আগস্টে আরও বিপর্যয় বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে স্বল্পমূল্যের পণ্যেও ঋণপত্র খুলতে সহায়তা করা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মানলে বিপদ বাড়বে। সামনের জাতীয় নির্বাচনও বিবেচনায় রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহসভাপতি মো. শহিদুল আজিম বলেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ-তেল সংকটের কারণে পোশাকশিল্পে এখন ক্রেতা নেই। সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে না পাড়ার কারণে ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন ক্রয়াদেশ পাওয়া কঠিন। এ সংকট উত্তরণে গ্যাস-বিদ্যুতের চুরি বন্ধ করতে হবে। অবৈধ সংযোগ বন্ধ করতে হবে। গ্যাস-বিদ্যুৎ-তেল খাতের অব্যবস্থাপনা বন্ধ করতে হবে। তেল আমদানি করতে হবে। অতীতের লোকসান পোষাতে এবং লাভের চিন্তা করে তেল আমদানি করা যাবে না। বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) উপদেষ্টা এ এইচ আসলাম সানী বলেন, ‘দেশের বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে বিশাল বিনিয়োগ করল সরকার। এখন পায়রা ও রামপালের কেন্দ্র দুটিতে কয়লা সরবরাহ করতে না পারলে পুরো বিনিয়োগ ধ্বংস হয়ে যাবে। রিজার্ভ ধরে রাখতে গিয়ে উৎপাদনশীল খাত স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও তেল রিজার্ভ বাড়াবে। আমাদের কৃষককে বিদ্যুৎ দিতে হবে। রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে গিয়ে পুরো অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে এটা হতে পারে না। না খেয়ে মরে যাব আর রিজার্ভ রক্ষা হবে, এ ধরনের নীতিতে কিছুই রক্ষা হবে না।’ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র বলছে, সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা আছে ১৫ হাজার ২০০ মেগাওয়াট আর উৎপাদন সক্ষমতা আছে ১৫ হাজার ৩১ মেগাওয়াট। ১৮৯ মেগাওয়াট ঘাটতি থাকছে। বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১৫৩টি। ৫২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ আছে। তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো আগেই বন্ধ করা হয় জ্বালানি তেলের অভাবে। ভরসা ছিল কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো। কেন্দ্রগুলোতে দিনে গ্যাসের চাহিদা ১ হাজার ৪০০ এমএমসিএফটি। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে গড়ে ৮০০ এমএমসিএফটি, যা সক্ষমতার অর্ধেক বা এর চেয়ে কিছু বেশি। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এখন ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট। সক্ষমতার ৪৭ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক। গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ৩৯ মেগাওয়াট। ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩ হাজার ৪৪০ মেগাওয়াট। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি তেল, কয়লা ও এলএনজি আমদানি ব্যাহত হওয়ায় সক্ষমতার ৩০-৪০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। সূত্র বলছে, দেশে উৎপাদিত গ্যাসের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজিকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় গ্যাসে রূপান্তর করে তা সরবরাহ করা হয়। মহেশখালীর ভাসমান টার্মিনাল দুটির মাধ্যমে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা থাকলেও সীমাবদ্ধতার কারণে পুরো মাত্রায় গ্যাস সরবরাহ করা হয় না। শুক্রবার রাতে বন্ধের আগেও টার্মিনাল দুটি থেকে ৬২৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গড়ে সরবরাহ করা হয় ২ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতির ফলে দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাসের বড় সংকট চলছে। এতে শিল্প-কারখানা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বাসাবাড়িতে রান্নার কাজেও সমস্যার মুখে পড়ছেন ভোক্তারা। এমন পরিস্থিতিতে তিন দিন ধরে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ থাকায় গ্যাস সরবরাহ ২ হাজার ১৫০ থেকে ২ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে সংকট আরও বেড়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর