দ্বাদশ নির্বাচন ঘিরে ইতোমধ্যে চাঙা থাকা কূটনৈতিক অঙ্গন আরেক দফায় সরগরম হতে যাচ্ছে আগামী মাসে। ঈদুল আজহার পরপরই ঢাকা আসছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দুটি শক্তিশালী প্রতিনিধি দল। ৮ জুলাই প্রায় দুই সপ্তাহের জন্য আসবে ইইউয়ের অনুসন্ধানী মিশন। এ মিশনের ঢাকা সফর শেষ হওয়ার আগেই আসবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের প্রতিনিধি দল। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের চার সদস্যের এ দলের সফর হতে পারে জুলাইয়ের মাঝামাঝি। ফলে ঈদের পর আরেক দফায় ব্যস্ত হতে যাচ্ছে কূটনৈতিক অঙ্গন।
কূটনৈতিক সূত্রের খবর, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা দেওয়া যুক্তরাষ্ট্র তাদের উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক প্রতিনিধি দল পাঠাতে যাচ্ছে। ভিসানীতি ঘোষণা করার পর এটাই হবে তাদের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিনিধি দলের সফর। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। অবশ্য প্রতিনিধি দলে নিশ্চিতভাবেই থাকছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুসহ আরও দুই কর্মকর্তা। ওয়াশিংটনে এক কূটনৈতিক সূত্র গণমাধ্যমকে জানান, সম্ভবত রাজনৈতিক বিষয় নিয়েই আলোচনা করবে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলটি। তারা ক্ষমতাসীনসহ সব রাজনৈতিক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করতে পারে। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানান, সফর চূড়ান্ত হলে এবারের আলোচনায় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও রোহিঙ্গা ইস্যু অগ্রাধিকার পেতে পারে।
এর আগে গত বছরের মার্চে বাংলাদেশের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিতে ঢাকায় আসেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। অন্যদিকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঢাকায় এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। ওই সফরে সম্পর্কোন্নয়নের ঘোষণা দিয়ে ঢাকা ছেড়েছিলেন তিনি। পরে গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির পর এ নীতির সরাসরি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে ডোনাল্ড লু বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দেশ, যেটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি রাখে।’অন্যদিকে বাংলাদেশে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল পাঠানো হবে কি না তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ঢাকা আসছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একটি অনুসন্ধানী মিশন। ইইউয়ের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি জোসেফ বোরেলের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কাজ করবেন এ মিশনের কর্মকর্তারা। প্রতিনিধি দলটি ৮ জুলাই বাংলাদেশে পৌঁছবে। ১৩ দিনের সফরে তারা এখানকার নির্বাচনী পরিবেশ ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবে। সংকট নিরসনে প্রতিনিধি দলটি এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের বিষয়ে আলাপ করবে। তারা ফিরে গিয়ে জোসেফ বোরেলের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে।
এ বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুখপাত্র পিটার স্টেনো জানিয়েছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন পরিস্থিতি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করছে ইইউ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে পর্যবেক্ষক পাঠাতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বাংলাদেশ। তাই নির্বাচনের উপযোগ্যতা, পরামর্শযোগ্যতা ও সম্ভাব্যতা যাচাই করতে জুলাইয়ে একটি অনুসন্ধানী মিশন পাঠাবে ইইউ। এ নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক হয় তা নিশ্চিত করতে সব রকম প্রচেষ্টা উৎসাহিত করছে ইইউ। অন্যদিকে ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি সম্প্রতি জানিয়েছেন, নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ ইইউ পর্যবেক্ষক দল পাঠানো ‘কার্যকর’ হবে কি না তা খতিয়ে দেখবে ওই মিশন। সফরকারী দলের ওই প্রতিবেদন ইইউয়ের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি জোসেফ বোরেলের কাছে যাবে। তিনি বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেশে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেবেন। ইতোমধ্যে বোরেল বলেছেন, পর্যবেক্ষক মিশন তখনই মোতায়েন করা হবে, যদি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য কোন কোন বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হবে, তা পর্যালোচনা মিশনের প্রতিবেদনে উঠে আসবে জানিয়ে ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেছেন, জোসেফ বোরেল বলেননি যে অমুক দল অংশগ্রহণ করতে হবে বা তমুক দল অংশগ্রহণ করতে হবে। পর্যালোচনা দল অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে দেখবে। তারা সব দলের সঙ্গে বৈঠক করবে এবং পর্যবেক্ষণ জানাবে যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হিসেবে কী কী বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হবে। পর্যালোচনা দলকে স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দল হিসেবে অভিহিত করে রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, এটা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রথম ধাপ। এরা ইইউ কর্মকর্তা বা আমলা নন। দলটি সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে বসবে। এটা শুধু নির্বাচনের বিষয় নয়, এখানে দেখা হবে একটি নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ও, যাতে নিরাপত্তার বিষয়ও রয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে নির্বাচনে অনিয়ম করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে বলে সিদ্বান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বিবৃতিতে ঘোষিত নীতিতে বলা হয়েছে, এ নীতির অধীনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ করবে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত নতুন ভিসানীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ভিসানীতিকে স্বাগত জানিয়েছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এবং এর প্রভাবও পড়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।