মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাতভর বোমা অবরুদ্ধ ফিলিস্তিন

প্রতিদিন ডেস্ক

রাতভর বোমা অবরুদ্ধ ফিলিস্তিন

ইসরায়েলকে রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরীসহ যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমানের বহর রওনা হওয়ায় হামাস ও ইসরায়েলের সংঘাত নতুন মাত্রা পেতে চলেছে। এরই মধ্যে লেবানিজ সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ঘোষণা দিয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল-হামাস সংঘাতে হস্তক্ষেপ করলে মধ্যপ্রাচ্যের সব মার্কিনি অবস্থানে হামলা চালানো হবে, কোনো রেডলাইন রাখা হবে না।’ রাশিয়া বলেছে, এ যুদ্ধ এখন পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে   পড়তে যাচ্ছে। এদিকে গতকাল গাজা ও লেবানন সীমান্ত এলাকায় ইসরাইয়েলি সেনাদের সঙ্গে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের তীব্র লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেছে। এর আগে পুরো গাজার ওপর সর্বাত্মক অবরোধ আরোপের ঘোষণা দিয়ে ইসরায়েলি বিমান থেকে সারা রাত বোমা বর্ষণ করা হয়। এতে ধ্বংস ও মৃত্যুর উপত্যকায় পরিণত হয় অঞ্চলটি। গতকাল বিকাল পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, তিন দিনের যুদ্ধে সেনাসহ ৮০০ ইসরায়েলি নিহত ও অন্তত আড়াই হাজার আহত হয়েছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে ৫৬০-এ এবং আহতের সংখ্যা অন্তত ৩ হাজার। সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, আলজাজিরা, এপি ও পার্স টুডে।

একটি খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েলকে সহায়তায় বিমানবাহী রণতরীসহ কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। হামাসের বিরুদ্ধে এ লড়াইয়ে ইসরায়েলকে বাড়তি যুদ্ধসরঞ্জাম ও গোলাবারুদ দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ঘোষণার পরপরই ইতালির ভূমধ্যসাগর উপকূলে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক জ্বালানিসমৃদ্ধ বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড পূর্ব ভূমধ্যসাগরের দিকে রওনা হয়েছে। মার্কিন যুদ্ধজাহাজের এ বহরে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী চারটি ডেস্ট্রয়ার ও একটি ক্রুজারও রয়েছে। এ ছাড়া এফ-৩৫, এফ-১৫, এফ-১৬ ও এ-১০ যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে ওই অঞ্চলে অবস্থান শক্ত করতে যাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। আরেক খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েল-হামাস সংঘাতে মার্কিন হস্তক্ষেপ হলে মধ্যপ্রাচ্যের সব মার্কিন অবস্থানে হামলা চালানো হবে বলে হুমকি দিয়েছে লেবানিজ সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর ঘোষণা দেওয়ার পরপরই এ হুঁশিয়ারি দিয়েছে লেবাননভিত্তিক সংগঠনটি। এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহর মুখপাত্র বলেছেন, ‘ফিলিস্তিন ইউক্রেন নয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি (ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে) সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, তাহলে এ অঞ্চলের সব মার্কিন অবস্থান প্রতিরোধ বাহিনীর লক্ষ্যে পরিণত হবে এবং আমাদের আক্রমণের মুখোমুখি হবে, এবং সেদিন কোনো লাল রেখা (রেডলাইন) থাকবে না।’

এদিকে ফিলিস্তিনের আল কাসেম ব্রিগেড ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন যুদ্ধের মধ্যেই নতুন অস্ত্র উন্মোচন করেছে। নতুন এ অস্ত্র মূলত কাঁধ থেকে চালিত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। চলমান যুদ্ধেই এটি ব্যবহার শুরু করেছে আল কাসেম ব্রিগেড। একটি ভিডিওচিত্রে এ অস্ত্র দিয়ে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের গুলি ছুড়তে এবং আকাশে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতেও দেখা গেছে।

প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, এরই মধ্যে গাজার ওপর ‘সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করেছে ইসরায়েল। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গালান্ট জানিয়েছেন, গাজার বিদ্যুৎসংযোগ কেটে দেওয়ার পাশাপাশি সেখানে খাদ্য ও জ্বালানি প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তিনি আরও জানান, হামাসের হামলা মোকাবিলায় ৩ লাখ রিজার্ভ সেনা ডেকেছে ইসরায়েল। এর আগে ১ লাখ রিজার্ভ সেনা ডাকার কথা ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন তা ৩ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর প্রধান মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হ্যাগারি সাংবাদিকদের বলেছেন, সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ইসরায়েলের। তিনি দাবি করেন, গতকাল সকালে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। এ পর্যায়ে সেখানকার সম্প্রদায়ের মাঝে কোনো ধরনের সংঘাত হচ্ছে না। তবে এখনো ওই অঞ্চলে হামাসের যোদ্ধারা থাকতে পারে।

আরেক খবরে জানা গেছে, রবিবার দিনের পর সারা রাত অবরুদ্ধ গাজায় বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গাজার শতাধিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে।

 এক সূত্র জানান, এ হামলায় ফিলিস্তিনের ১৫৯টি বেসামরিক ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। আরও ১ হাজার ২০০-এর বেশি আবাসিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা বলছে, ২২৫ জনের বেশি লোক আশ্রয় নেওয়া একটি স্কুলে সরাসরি হামলা চালায় ইসরায়েল। এমন বাস্তবতায় অনেকটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা উপত্যকা। চারদিকে সাধারণ মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ। সবকিছু হারিয়ে পথে বসে পড়েছেন অনেকে। এ অবস্থায় যে যেভাবে পেরেছেন উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিয়েছেন। হাসপাতালগুলোয় আহতদের চাপ বাড়তে থাকায় হিমশিম খাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। মানবিক পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। জাতিসংঘের বরাতে একটি গণমাধ্যম জানিয়েছে, ইসরায়েলের ব্যাপক বিমান হামলায় গাজায় নতুন করে ১ লাখ ২৩ হাজার বাসিন্দা গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে ৭৪ হাজার মানুষ বিভিন্ন স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন।

ইসরায়েলজুড়ে বিমান হামলার সাইরেন : গাজা থেকে ইসরায়েলে ঘন ঘন রকেট ছুড়ছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। হামলার ঘটনায় জেরুজালেম ও ইসরায়েল জুড়ে বিমান হামলার সাইরেন বাজছে। গতকাল ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এ তথ্য জানিয়েছে। সংবাদসূত্রগুলো জানিয়েছেন, গাজা থেকে রকেট ছুড়তে থাকায় জেরুজালেমে গতকাল অন্তত তিনটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। তবে এগুলো রকেট আছড়ে পড়ার পর বিস্ফোরণের শব্দ নাকি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রকেটকে বাধা দিয়েছে, তার শব্দ- তা স্পষ্ট নয়।

কাসসাম ব্রিগেডের বিবৃতি : ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখা ইজাদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু উবায়দা জানিয়েছেন, তাঁরা নতুন করে আরও একদল ইসরায়েলি সেনাকে বন্দি করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি জানান, দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের বিশাল আকারের সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রেকর্ড করা বিবৃতিতে তিনি আরও জানান, অভিযানের দ্বিতীয় দিন রবিবার তাঁরা ইসরায়েলের একদল সেনাকে আটক করতে সক্ষম হন এবং তাদের বন্দি করে গাজা উপত্যকায় নিয়ে যাওয়া হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা প্রস্তাবে সায় নেই : ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি ভিত্তিতে রবিবার রাতে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছিল। তবে যৌথ বিবৃতি দেওয়ার জন্য তারা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। জানা গেছে, বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে হামাসের বিরুদ্ধে কড়া নিন্দার প্রস্তাব তোলে। তবে এতে অন্য কোনো দেশই সায় দেয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্র এ প্রসঙ্গে বলেছে, তাদের প্রস্তাবে সর্বসম্মতভাবে সায় মেলেনি। খবরে বলা হয়, নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক প্রায় ৯০ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। সেখানে জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক শান্তিদূত টর উইনেসল্যান্ডের ব্রিফ শোনেন সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা। কূটনীতিকরা বলছেন, বৈঠকে উপস্থিত রুশ প্রতিনিধিরা হামাসের নিন্দা জানানোর চেয়ে বিষয়টিকে আরও বিস্তৃত পরিসরে দেখার কথা বলেন।

ইরানের সমর্থন : ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ওয়ানা নিউজ এজেন্সিতে এক ভিডিও বার্তায় হামাসের নজিরবিহীন অভিযানকে ‘ফিলিস্তিনি যোদ্ধা এবং ফিলিস্তিনি গ্রুপগুলোর বিজয়’ বলে অভিহিত করেছেন। অন্য এক বার্তায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান হামাসের হামলাকে ‘বছরের পর বছর ধরে চলা হত্যা ও অপরাধের বিরুদ্ধে বৈধ জবাব’ বলে উল্লেখ করেন।

জেলেনস্কির দাবি : চলমান যুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ফিলিস্তিনি হামাস আর রাশিয়ার মধ্যে কোনো তফাত নেই। গতকাল ন্যাটোর সংসদীয় সমাবেশে এক ভিডিও বার্তায় জেলেনস্কি বলেন, দুটি একই ধরনের খারাপ। শুধু পার্থক্য হলো, ইসরায়েলকে আক্রমণ করেছে একটি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’, আর ইউক্রেনকে আক্রমণ করেছে একটি ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’। এরপর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সরাসরি ফোনে কথাও বলেন ভলোদিমির জেলেনস্কি। এ সময়ও ইসরায়েলিদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

 

সর্বশেষ খবর