দেশের সরকারি পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতে বই আছে পাঠক নেই। লাখ লাখ বই, পুরনো খবরের কাগজ, ইতিহাসের দুষ্প্রাপ্য দলিলসমৃদ্ধ এসব লাইব্রেরিতে পাঠকের সংখ্যা হাতে গোনা। ডিজিটাল সামাজিক রূপান্তরে মুদ্রিত বইয়ের পাঠক কমছে। সৃজনশীল বইয়ের পাঠকরা এখন আর আগের মতো লাইব্রেরিতে পড়তে যান না। সরকারি চাকরিপ্রার্থীরা এখন লাইব্রেরিতে ভিড় করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে। পাঠকের আগ্রহ কমে যাওয়ায় লাইব্রেরিগুলোতে সৃজনশীল নতুন বই আসছে কম। পুরনো বইয়ের ওপর বাড়ছে ধুলোর স্তর। একদিকে পাঠক কমছে অন্যদিকে প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে অনেক গ্রন্থাগার নিজেদের বিপুলসংখ্যক বইয়ের সম্ভার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। বিপুল জনগোষ্ঠীর দেশে ক্রমবর্ধমান এই পাঠবিমুখতা জাতির জন্য হতাশাজনক ভবিষ্যৎ বয়ে আনতে পারে বলে মনে করছেন গবেষক ও শিক্ষাবিদরা।
দেশের ছয়টি বিভাগীয় সরকারি পাবলিক লাইব্রেরির তথ্য বলছে, গত এক দশকে পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতে পাঠকের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ঢাকাসহ সারা দেশেই তরুণদের পাঠাভ্যাসে যেমন ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, তেমনি অনেক জায়গায়ই পাড়া-মহল্লার পুরনো ছোট লাইব্রেরিগুলো বন্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ গ্রন্থাগার অধিদফতরের অধীনে দেশে ৭১টি পাবলিক লাইব্রেরি রয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সঙ্গে যুক্ত লাইব্রেরির সংখ্যা প্রায় ১ হাজারের মতো। এ ছাড়া বিশেষ গ্রন্থাগার এবং ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা লাইব্রেরি আছে আরও কয়েক হাজার। কিন্তু এসব গ্রন্থাগারের বেশির ভাগই পাঠক পাচ্ছে না। যারা পড়তে যান তাদেরও বড় অংশ যান চাকরির পরীক্ষা বা বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে। বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরির সর্বশেষ চিত্র তুলে এনেছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদকরা।
এদিকে ‘পাবলিক লাইব্রেরি’ খ্যাত রাজধানীর শাহবাগের লাল ইট প্রশস্ত সিঁড়ি ও নান্দনিক স্থাপত্যের গণগ্রন্থাগার এখন স্মৃতি হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে অবস্থিত গণগ্রন্থাগার অধিদফতর ও সুফিয়া কামাল জাতীয় গ্রন্থাগার এরই মধ্যে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। গত বছর ১৩ এপ্রিল সুফিয়া কামাল জাতীয় গ্রন্থাগার স্থানান্তর হয়েছে রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের ১৩ তলায়। গণগ্রন্থাগার অধিদফতর ভবন ও জাতীয় জাদুঘর ভবনকে সমন্বিত করে নতুন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ‘গণগ্রন্থাগার অধিদফতরের বহুতল ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৫২৪ কোটি টাকার প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। পাবলিক লাইব্রেরি রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের ১৩ তলায় স্থানান্তর হলেও সেখানে এখন আর তেমন পাঠক যান না।
এদিকে শাহবাগের কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে গেলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার নিয়মিত শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারছে না। সেখানে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে আসা চাকরিপ্রার্থীদের ভিড় বাড়ছে, যাদের অধিকাংশের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে ইতোমধ্যে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের লাইব্রেরিতে জায়গা পান না। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার থেকে শিক্ষার্থীদের বই ইস্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৩-২০০৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০১১-২০১২ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত প্রতি শিক্ষাবর্ষেই প্রায় ৮ লাখ বই ইস্যু হতো। ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে এর পরিমাণ ক্রমেই কমছে। ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে এখন এই পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজারেরও নিচে। ২০০৩-২০০৪ শিক্ষাবর্ষে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে বই ইস্যু হয়েছে ৭৫৭২০০ কপি। বিজ্ঞান গ্রন্থাগারে এর পরিমাণ ছিল ১৯৫৭৫ কপি। আর ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে বই ইস্যু হয়েছে ২৫১৪৯ কপি। বিজ্ঞান গ্রন্থাগারে এই পরিমাণ মাত্র ৬৩২ কপি। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০০৩-২০০৪ শিক্ষাবর্ষে ২৯৪ কার্যদিবসে গড়ে প্রতিদিন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি থেকে বই ইস্যু হয়েছে ২৫৭৫ কপি। বিজ্ঞান শাখায় এর পরিমাণ ৬৬ কপি। আর ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ২৭৭ কার্যদিবসে গড়ে প্রতিদিন কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে বই ইস্যু হয়েছে ৯০ কপি। বিজ্ঞান শাখায় এর পরিমাণ মাত্র ২ কপি।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের টেবিলে সারি সারি বই রাখা। সবাই পড়ছেন চাকরির প্রস্তুতির নানা গাইড বই। লাইব্রেরিতে নিয়মিত পড়েন এমন শিক্ষার্থীরা জানান, কোচিং সেন্টারের শিট/গাইড পড়ে তারা চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী পাওয়া যায় যারা লাইব্রেরি থেকে বই ইস্যু করে পড়েন। কলা অনুষদের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছরে কখনো লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়েননি তিনি। এই চিত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও হাজার হাজার শিক্ষার্থীর। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের ধারণক্ষমতার পাঁচ ভাগের চার ভাগই দখল করে বিসিএস প্রস্তুতি নেন ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়া এসব শিক্ষার্থী। ফলে বর্তমান শিক্ষার্থীদের কেউ গ্রন্থাগারের বই নিয়ে পড়তে চাইলেও লাইব্রেরিতে সে সুযোগ খুব কম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক ড. মো. নাসিরুদ্দিন মুন্সী বলেন, শিক্ষার্থীরা এখন সবাই চাকরিমুখী পড়াশোনা করেন। এ ছাড়া ক্লাসে শিক্ষকরা যা পড়ান তার শিট শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়। যে কারণে তারা লাইব্রেরিমুখী হচ্ছেন কম। শিট পড়েই পরীক্ষায় পাস করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাইলে গ্রাজুয়েটদের ক্যারিয়ার গঠনের জন্য দেখভাল করতে পারে। বড় বড় পাঠকক্ষ তৈরি করে দিতে পারে। কিন্তু কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, যেমন নিবিড় জ্ঞান অনুশীলন ও উৎপাদনের কথা, সেখানকার পরিবেশ নষ্ট করে এমন সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। হলের আবাসন সমস্যা সমাধান করা গেলে এ সমস্যা আপনাআপনি কেটে যাবে বলে মনে করেন ড. মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্র ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীরা এখন বই পড়ার আনন্দ মোবাইল ফোনে, ইন্টারনেটে খুঁজছেন। অনেকে ইন্টারনেটে বই দেখছেন। বই দেখার ব্যাপার না, পড়ার। বই বলতে আমরা বুঝি বাঁধানো ও ছাপানো জিনিস। এখন এই ধারণা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান এই পাঠবিমুখতা জাতির জন্য হতাশাজনক ভবিষ্যৎ বয়ে আনতে পারে।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        