মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বাবার লাশ বা কবরের সন্ধান পাবেন না কখনো। এ সত্যিটা জেনেও দেশের বেশির ভাগ বধ্যভূমিতে গিয়ে বাবার পরশ খোঁজার চেষ্টা করছেন কন্যা সেলিনা রশিদ। বাবার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ দেশের ৩৪০ বধ্যভূমির মাটি সংগ্রহ করেছেন তিনি। সেই মাটি দিয়ে ময়মনসিংহের ভালুকায় গড়ে তুলেছেন ব্যতিক্রমী এক বিশাল সংগ্রহশালা।
তাঁর বিশ্বাস, এই বধ্যভূমির কোনো একটিতে তাঁর বাবা জহির উদ্দিন মিশে আছেন। পাশাপাশি তাঁর সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি পারের মাটি, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কবরের মাটি, ভাষা শহীদ, ভাষাসৈনিক এবং জাতীয় চার নেতার কবর পারের মাটি। এখনো কোনো বধ্যভূমির খবর পেলে সেখানে ছুটে যান সেলিনা। সংগ্রহ করেন সেখানকার পবিত্র মাটি। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি সংগ্রহ করা এসব স্মৃতিচিহ্নে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তিনি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও বিশিষ্টজনেরা সেলিনার এ ব্যতিক্রমী সংগ্রহশালা পরিদর্শন করেছেন। সেনাবাহিনীতে চাকরির সুবাদে সেলিনার বাবা জহির উদ্দিন ছিলেন অস্ত্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। দিনাজপুর, রংপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে ৬ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন তিনি। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ সকালে স্ত্রী ও চার মেয়েকে বাড়িতে রেখে বের হয়ে নীলফামারীর সৈয়দপুরের ক্যাম্পে যান সেলিনার বাবা। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে সেলিনার মা আনোয়ারার কাছে একটি টেলিগ্রাম আসে, ‘মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন নিখোঁজ!’ এর কিছুদিন পর আরেকটি টেলিগ্রাম আসে। সেখানে লেখা ছিল, ‘মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিনকে পাক বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে।’ এরপর থেকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিনের স্ত্রী-সন্তানদের ওপর নেমে আসে স্বজনদের নির্যাতনের খড়্গ। জোর করে তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি ও উত্তরাধিকারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। নির্মম-নিষ্ঠুরতায় কাটতে থাকে সেলিনার পরিবারের দিনগুলো। বিয়ের পর তিনি এইচএসসি, ডিগ্রি, এমএ, এমবিএ ও পিএইচডি অর্জন করেন। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায় বাবার স্মৃতি। কতজনের বাবাই তো যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে এসেছেন। অথচ তাঁর বাবা ফিরলেন না। সেই থেকে তিনি শুরু করেন বাবাকে খোঁজা। বছরের পর বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বধ্যভূমিগুলোতে যেতে শুরু করেন। তাঁর বিশ্বাস হয়তো এসব বধ্যভূমির কোনো একটির পবিত্র মাটিতে শুয়ে আছেন তাঁর বাবা। সংগ্রহশালার প্রতিষ্ঠাতা ড. সেলিনা রশিদ বলেন, ‘পুরো দেশটাকে মনে হয় আমার বাবার সমাধিস্থল। বাবার রক্তে ভেজা এ বাংলার মাটি বড় বেশিই পবিত্র। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১০ বছর। চার বোন আর মাকে শ্রীপুরের চকপাড়া গ্রামের বাড়িতে রেখে বাবা চলে যান যুদ্ধে। ফিরে আসার কথা ছিল, বাবা আসেননি।