"নারায়ণগঞ্জবাসী সিংহাম উপাধি দিয়ে পোস্টার লাগিয়েছিল, শফি হুজুর বাবুনগরীকে নজরবন্দি, মামুনুল হককে আটক করেছিলাম, জেনারেল সারওয়ার্দীকে গ্রেফতার করে ভোটের ষড়যন্ত্র জেনেছিলাম, ১৫০০ কোটি টাকা কেউ কি গাড়িতে নিয়ে ঘোরে"
রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। তবুও ভুক্তভোগী মানুষের আস্থা। নানা শ্রেণিপেশার মানুষ বিপদে-আপদে ছুটে যান। কর্তৃপক্ষও ভরসা রাখছেন। বহুমাত্রিক অপরাধ দমনে নানা তৎপরতার কারণে প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। কিছু বিষয়ে নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হচ্ছেন মাঝেমধ্যেই। তিনি হলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত হাওর এলাকা থেকে উঠে আসা পুলিশের ২০ ব্যাচের এই কর্মকর্তা। নিজের জীবনের নানা সংগ্রাম, অর্জন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের মুখোমুখি হয়েছেন। নিচে তা হুবহু তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ডিবি পুলিশ জনগণের সেবায় সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে কি?
ডিবি প্রধান : মানুষকে সেবা দিতে আমরা দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করছি। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সঠিকভাবে আইনি সেবা দেওয়াটাই আমাদের বড় দায়িত্ব মনে করি। মানুষ খুশি থাকলে আমরা খুশি। মানুষের সেবা দিতে পারলে আমারও ভালো লাগে। আমৃত্যু মানুষের সেবা করে যেতে চাই। প্রযুক্তির যুগে অপরাধ করে কেউ যদি মনে করে পালিয়ে বাঁচতে পারবে সেটা আর সম্ভব নয়। দল-মত নির্বিশেষে অনেক বড় বড় অপরাধীকে আমরা আইনের আওতায় এনেছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : প্রায় ২ কোটি মানুষের এই শহরে সাধারণ মানুষের সুরক্ষায় ডিবি কী ধরনের কাজ করছে?
ডিবি প্রধান : মহানগরীতে মানুষ বেশি থাকায় অপরাধও বেশি হয়। তবে আমরা চেষ্টা করছি অপরাধীদের নজরদারিতে রাখতে। অনেক অপরাধ আগেই ঠেকিয়ে দেওয়া হচ্ছে; যা মানুষ কখনো বুঝতেও পারেনি। অন্যায়কারীরা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। দল-মত নির্বিশেষে অর্পিত দায়িত্ব পালনে অটল রয়েছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ডিবির ওপর মানুষের যে আস্থা রয়েছে সেটা সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন কি না?
ডিবি প্রধান : দেখুন, ২০২২ সালের ১৭ জুলাই ডিএমপি গোয়েন্দা শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিই। আর ডিবিপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাত্র ছয় মাসেই সাধারণ মানুষের আস্থার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করছি। ইয়াং, এনার্জেটিক অফিসাররা তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। নানা শ্রেণিপেশার মানুষ কোনো সমস্যা হলেই ডিবির কাছে ছুটে আসছে। ১৯ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে মায়ের বুকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক নেতার হত্যাকারী সন্ত্রাসীকে বিদেশ থেকে গ্রেফতার করে ফিরিয়ে এনেছে ডিবি। সম্পত্তি বিক্রির টাকা কেড়ে নিয়ে বাবা-মাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া সন্তানদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেওয়া, কোলের শিশুকে হারিয়ে দিশাহারা মায়ের বুকে সন্তান ফিরিয়ে দেওয়াসহ নানা হৃদয়গ্রাহী কাজ করে মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছি আমরা। আস্থা-ভরসা না থাকলে এমনটা হতো?
বাংলাদেশ প্রতিদিন : গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জে পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন, ডিএমপিতেও বিভিন্ন ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করেছেন। কোনটাকে এগিয়ে রাখবেন?
ডিবিপ্রধান : পুলিশ বাহিনীতে যোগদানের পর সব পদে থেকেই আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়েই কাজ করেছি। সেই হেফাজতে ইসলামের তান্ডবের সময় লালবাগ বিভাগের ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। সে সময় প্রয়াত শফি হুজুর, বাবুনগরী লালবাগ মাদরাসায় অবস্থান করে সব কলকাঠি নাড়ছিলেন। আমি তাদের প্রতিটি বিষয় নজরদারিতে রেখেছিলাম। একপর্যায়ে মাওলানা বাবুনগরীকে বিমানবন্দর থেকে আটক করে নিয়ে আসি। শুরুতে শীর্ষ কিছু কর্মকর্তা বিষয়টিতে নাখোশ হলেও বর্তমান এসবিপ্রধান আমার এ কাজের প্রশংসা করেছিলেন। বাবুনাগরীর কাছ থেকেই আমরা অনেক তথ্য পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে ডিসি তেজগাঁও হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় মাওলানা মামুনুল হককে আমি গ্রেফতার করেছিলাম। কোনো ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়াই তাকে তার মাদরাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গাজীপুরের দায়িত্ব পালনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ২৪ আগস্ট গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে নিয়োগ পাই আমি। সেখানে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে চার বছর মেয়াদ পূর্ণ করি। গাজীপুরে দায়িত্ব পালনকালে অসহায় ও গরিব মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দিয়েছি। গাজীপুরের পর মাদক-সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জে পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব নিই ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর। মাদক কারবারি আর ভূমি দখলদারদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করি। নারায়ণগঞ্জে সাধারণ মানুষ আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ‘বাংলার সিংহাম’ উপাধিতে ভূষিত করে। শহরের অলিগলি, পাড়া-মহল্লায় পোস্টার-ব্যানার সাঁটিয়ে দেয়। নারায়ণগঞ্জে মাত্র ১১ মাস কাজ করার একপর্যায়ে ষড়যন্ত্রের শিকার হই। যদিও পরে পুলিশের বিভাগীয় তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হই। এরপর দেশ ও মানুষের সেবায় নবউদ্যমে নিজেকে নিযুক্ত করি।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের দায়িত্বের স্মৃতি মন্থন করে বলেন, করোনাকালে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। মানুষকে ধোঁকা দিয়ে ভুয়া করোনার সনদ বিক্রিতে অভিযুক্ত চিকিৎসক সাবরিনাসহ দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতার করে মুখোশ উন্মোচন করি। সে সময় জনসাধারণের সেবায় নানামুখী সহায়তা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করি। এ অঞ্চলে শিল্পাঞ্চল, সংসদ সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কার্যালয় এবং খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্বাচনি এলাকা থাকায় বাড়তি দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সঠিকভাবে পালন করার চেষ্টা করেছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বর্তমান কর্মস্থল সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
ডিবিপ্রধান : ২০২১ সালের ১৩ মে পুলিশ সুপার থেকে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক বা অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পাই। ১৭ মে ডিএমপি গোয়েন্দা বিভাগ উত্তরের যুগ্ম কমিশনারের দায়িত্ব পাই। ওই পদে থাকাবস্থায় গত বছরের ১৩ জুলাই উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক বা ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পাই। আগেও বলেছি, ডিবির ইয়াং-এনার্জেটিক সদস্যদের মাধ্যমে আমরা বারবার এর প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছি। এ জন্যই হয়তো মানুষ ডিবির কাছে বেশি প্রত্যাশা করছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনেক ষড়যন্ত্রকারীর মুখোশ উন্মোচিত করেছে ডিবি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের মাত্র অল্প সময়ের মধ্যে সাবেক সেনা কর্মকর্তা লে. হাসান সারওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরবর্তীতে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ভুয়া উপদেষ্টা মিয়া আরেফীকে গ্রেফতার করে জাতির সামনে সব কিছু উন্মোচন করা হয়।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে মোটা অঙ্কের অর্থ জব্দ, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছিল। সম্প্রতি নির্বাচনের আগে সিঙ্গাপুরে আপনি পালিয়েছেন বলে খবর রটেছিল, এ বিষয়ে কী বলবেন?
ডিবিপ্রধান : এফবিআই কি এতই বোকা প্রতিষ্ঠান! আমার অর্থ জব্দ করবে আর এ দেশকে জানাবে না? বাংলাদেশেও তো তাদের প্রতিনিধি রয়েছে। আর ১৫০০ কোটি টাকা কি কেউ গাড়িতে নিয়ে ঘোরে? দেখুন, আমার স্ত্রী শিরিন আক্তার ডিবি লটারি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গেছে। জন্মসূত্রে আমার দুই সন্তান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। কিছু লোক মিথ্যা গুজব রটিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কিছু পয়সা কামায়। আমি তাদের কিছু বলি না। কারণ এটা দিয়ে তারা রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেখুন ছাত্রজীবনে একটি ছাত্র সংগঠনের নেতা হওয়ার কারণে সারদা পুলিশ একাডেমিতে গিয়ে প্রতিদিন আমি আতঙ্কে ভুগতাম কখন বের করে দেয়। সত্যিই প্রশিক্ষণ শেষে সবাই যখন পাসিং আউট হয়ে যায় তখন আমি ছিলাম দর্শকের সারিতে। বিয়ের মাত্র দুই দিন আগে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বিয়েও ভেঙে যায়। যদিও পরবর্তীতে যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তাকেই আমি স্ত্রী হিসেবে পাই। আমার সংগ্রামের অনেক কিছুরই নীরব সাক্ষী সে। ওই বেকার জীবনে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিল মার্কেন্টাইল ব্যাংকে আমাকে চাকরি দিয়েছিলেন। কিছুদিন পর নাভানা গ্রুপেও আমার এক পরিচিত আমাকে চাকরি দেন। এর বাইরে ওই সময় শেয়ারবাজার থেকে বেশ অর্থ কামিয়েছি আমি। পাশাপাশি এলএলবি করেছি। যদিও বর্তমানে বারের লাইসেন্স স্থগিত রাখা হয়েছে। আমার অনেক সংগ্রামের সাক্ষী আমার পরিচিতজনরা।
বাংলাদেশ ক্যাডার সার্ভিসের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ২০তম ব্যাচে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে কর্মজীবন শুরু করেন হারুন-অর-রশীদ। চৌকশ পুলিশ কর্মকর্তা হারুন তাঁর ক্যারিয়ারে ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান। শুরুতে তিনি ঢাকার মিরপুরের সহকারী কমিশনার হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি গুলশানের সহকারী কমিশনার, তেজগাঁও ও লালবাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার, লালবাগের উপকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পুলিশ বাহিনীর নানা পর্যায়ের কর্মকর্তারা এখন একবাক্যে স্বীকার করেন, সময়ের সাহসী ও চৌকশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ প্রতিনিয়ত তাঁর কর্মদক্ষতার মাধ্যমে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে দায়িত্ব পালনে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের ফলে মোট পাঁচবার পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বিপিএম ও পিপিএম অর্জন করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।