অরাজকতার বিষবাষ্প যারা ছড়াবে তাদের কঠোর হস্তে দমন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অরাজকতার বিষবাষ্প এখন যে-ই ছড়াবে বিজয়ী ছাত্র-জনতাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পূর্ণ শক্তি তাকে ব্যর্থ করে দেবে।
তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন উৎসবের মুহূর্তে এ স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা দেশে একটি অরাজকতা ও ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। অরাজকতা আমাদের শত্রু। একে দ্রুত পরাজিত করতে হবে। গতকাল রাতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এ মুহূর্তে সরকারের প্রথম কর্তব্য হিসেবে আমরা এই যড়যন্ত্রকারীদের কঠিন হাতে দমন করব। স্বাধীনতার মুক্ত বাতাস যেন প্রত্যেকে বুক ভরে নিতে পারে এই নিশ্চয়তা দানই আমাদের সরকারের প্রথম প্রতিশ্রুতি। এই ব্যাপারে দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করছি। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার এই মিলনমেলা থেকে বাদ যাবে না আমাদের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও। সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, বর্ডার গার্ড, পুলিশ, আনসার, গ্রাম প্রতিরক্ষা, কোস্টগার্ড কেউ বাদ যাবে না। অন্য সবার মতো তাদের প্রত্যেক সদস্য আজ উপরওয়ালার আইনবহির্ভূত জবরদস্তিমূলক হুকুম থেকে মুক্ত। কারও জন্য এটা বিন্দুমাত্র ব্যাহত হলে আমাদের আজকের উৎসব ম্লান হয়ে যাবে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, প্রচ- নিষ্ঠুর পতিত স্বৈরাচারী সরকার এসব প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিল। আমরা তার এই চেষ্টা ব্যর্থ করে প্রতিষ্ঠানগুলোর হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনব। এই ঘৃণ্য চেষ্টায় ব্যবহৃত হয়ে যারা অপরাধ সংঘটিত করেছে তাদের আইনানুগ বিচারের মাধ্যমে শিগগিরই উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে। একই কথা দেশের সব মন্ত্রণালয়, সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নানা কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রযোজ্য। সব অপরাধীর বিচার করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজ দ্বিতীয়বার যারা স্বাধীনতার স্বাদ আমাদের সবার জন্য সম্ভব করল সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদ ছাত্র-জনতাকে এবং এতে আহত অসংখ্য আন্দোলনকারীকে স্মরণের মাধ্যমেই দেশবাসীর পক্ষ থেকে তা করছি। তাদের দুঃসাহসিক আত্মত্যাগ, সাহস ও সারা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া এ স্বাধীনতা অর্জন কখনোই সম্ভব হতো না। তিনি বলেন, সেই সঙ্গে তাদের সেই মুক্তির আকুতি উপলব্ধি করে সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীর যে অকুতোভয় সদস্যরা দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়ে এই বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছেন তাদের প্রতিও জানাই জাতির পরম কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজ প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান ও তার সদস্যরা নিজ নিজ কর্তব্য পালন করার মাধ্যমে দ্বিতীয় স্বাধীনতা উপভোগ করবেন। দেশকে গৌরবের শীর্ষে নিয়ে যাবেন এবং দেশবাসীকে ও জগৎবাসীকে উপভোগ করার সুযোগ করে দেবেন। আমি জাতির পক্ষ থেকে প্রত্যেককে নির্ভয়ে, আনন্দচিত্তে নিজ নিজ কর্মস্থলে নিজ নিজ সামর্থ্য নিয়ে এগিয়ে আসার অনুরোধ করছি। দেশের সব মানুষকে আজ স্বাধীন, নির্ভয়, নিরুদ্বেগ থাকার নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য আমাদের ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকার দেশের প্রত্যেকের সরকার। এখানে থাকবে সবার আকাক্সক্ষা পূরণের অধিকার। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী দূর হয়ে গেছে। কাল সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্র, সুবিচার, মানবাধিকারের নির্ভয়ে মতপ্রকাশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য, সবার স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। জীবনধারণের সুযোগ প্রদানের সচেষ্ট সরকারের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য ও সহমর্মী পরশ দলমত নির্বিশেষে সবাই উপভোগ করবেন এটাই আমাদের লক্ষ্য।হিংসা ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করুন : শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকায় ফিরে তাঁর প্রথম বক্তব্যেই বলেছেন, আজকে আমাদের গৌরবের দিন। যে বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন বিজয় দিবস সৃষ্টি করল তরুণরা, সেটাকে সামনে রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। যারা এটা সম্ভব করেছে, যে তরুণ সমাজ, তাদের প্রতি আমি আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তারা বাংলাদেশকে রক্ষা করেছে। নতুন করে পুনর্জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেন, নতুন বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নতুন বিজয় দিবস শুরু করল। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। যারা এটি করেছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, তারা (সমন্বয়করা) দেশকে রক্ষা করেছে। দেশকে পুনর্জন্ম দিয়েছে। আজকে আমার আবু সাঈদের (রংপুরে গুলিতে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী) কথা মনে পড়ছে। যে আবু সাঈদের কথা দেশের প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশে দ্বিতীয় স্বাধীনতা এসেছে। আবু সাঈদের কথা বলার সময় অধ্যাপক ড. ইউনূস কেঁদে ফেলেন। গতকাল দুপুর ২টা ১১ মিনিটে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফেরেন ড. ইউনূস। এ সময় তাঁকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন, নতুন আইজিপি ময়নুল ইসলাম এবং র্যাব মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এবং সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা শাহজালাল বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে অভ্যর্থনা জানান। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করাই হবে আমাদের প্রথম কাজ। দেশবাসীর কাছে আবেদন, আপনারা যদি আমার ওপর বিশ্বাস রাখেন, তবে দেশের কারও ওপরে হামলা হবে না। এরপর তিনি বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা তাঁর পাশে ছিলেন। সেখানে সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন, পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, উবিনিগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর মোহাম্মদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ছিলেন বিমানবন্দরে।
শপথ শেষে আহতদের দেখতে ঢামেকে প্রধান উপদেষ্টা : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের দেখতে গিয়েছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস। গতকাল রাত সাড়ে ১০টার পর তিনি তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রবেশ করেন। হাসপাতালে প্রবেশ করে তিনি আহতদের চিকিৎসার খোঁজ নেন।