দেশের তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের কিছু ব্যাংক ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এসব ব্যাংক কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে না রেখে নীতিমালার মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে সংস্থাটি জানিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৮-২০২৩) ব্যাংক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ৯২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। গতকাল ‘ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনতে করণীয়’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজ কার্যালয়ে এ ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে সিপিডি। এতে আরও বক্তব্য দেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ও গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘এই ব্যাংকগুলোর চলনশক্তি আর নেই। এগুলো ক্লিনিক্যালি ডেড হয়ে গেছে। এগুলো পুনর্ভরণ করে পুঁজির জোগান দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো কোনোভাবেই বেঁচে থাকার মতো অবস্থায় নেই। তারপরও এগুলো বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি অর্থ, জনগণের অর্থ খরচ হচ্ছে। এগুলো বন্ধ হয়ে যাক, প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যু হয়ে যাক, এটাই আমরা বলছি।’ এ ছাড়া কিছু ব্যাংক এখনো মৃতপ্রায় না হলেও ঢিমেতালে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ‘সেগুলোকে যদি চালানোর ইচ্ছা থাকে, তাহলে পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি পরিবর্তন করে আরেকবার চেষ্টা করা যেতে পারে।’ তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১১টি ব্যাংক আন্তর্জাতিক ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী বিভিন্ন হারে মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। এক সময়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ভালো ব্যাংক ছিল। এটিকে দখলের পরে সেটিও মুমূর্ষু হয়ে গেছে। দেশের ব্যাংক খাত এতদিন কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রসারে কাজ করেছে এমন অভিযোগ করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, গুটিকয়েক গোষ্ঠীর জন্য নিয়মনীতি প্রণয়ন করা হতো। সেই নিয়মনীতি আবার ওই গোষ্ঠীগুলোই ঠিক করে দিত। গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে ২৪টি বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব ঘটনায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকার বেশি ঋণ বেহাত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নররা যেসব নীতিমালা গ্রহণ করেছেন সেগুলো ব্যাংকিং আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেসব ভালো চর্চাগুলো ছিল সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে অথবা নতুন নিয়ম তৈরি করে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়েছেন তারা। এ অনিয়মের মাধ্যমে বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ চলে গেছে। এর প্রত্যেকটি ঘটনা তদন্ত এবং যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা উচিত। কিছুদিন আগের ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগকে আরও সুগঠিতভাবে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জোর দিয়েছে সিপিডি। সংস্থাটি মনে করে, জোর জবরদস্তি করে নয় বরং একীভূত করার পূর্বশর্তগুলো পূরণের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘একটি ভালো ব্যাংক কেন দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে, তার নিজেরও তো অনেক ঝুঁকি রয়েছে। দুর্বল ব্যাংকের অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করে তারপর মার্জ করতে হবে। সারা পৃথিবীতেই মার্জ প্রক্রিয়া বিদ্যমান। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো সফল হয়। কিন্তু মার্জ সফল হওয়ার পূর্বশর্তই হচ্ছে দুর্বল ব্যাংকের সঠিক মূল্যায়ন করা।’ বাংলাদেশে এখন মোট ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। এত ব্যাংক প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন ফাহমিদা খাতুন। এত ব্যাংকের লাইসেন্স কেন দেওয়া হয়েছে, সে প্রশ্নও তোলেন তিনি। সংবাদ সম্মেলন থেকে রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোতে পরিচালক নিয়োগের প্রক্রিয়াকে রাজনীতিমুক্ত করার সুপারিশ করেছে সিপিডি। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সুনামের ওপর ভিত্তি করে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।