শিরোনাম
সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

বেগম সাহেবরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে

অর্থ পাচার করে কানাডায় বেগমপাড়া

শাহেদ আলী ইরশাদ

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে দেদার হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে সব থেকে বেশি টাকা পাচার হয়েছে কানাডায়। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতা, আমলা ও ব্যবসায়ীসহ সরকারি কর্মচারীরাও পাচার করা টাকায় কানাডায় গড়ে তুলেছেন একের পর এক বেগমপাড়া। বাংলাদেশিদের ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে পরিচিত এসব বেগমপাড়ায় প্রাসাদসম বাড়ি কিনে গড়ে তুলেছেন তাদের অবৈধ স্বর্গ। বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ সম্পদের পাহাড় বানিয়েছেন দেশে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থে। দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া বহু রাজনীতিবিদ-আমলা-পেশাজীবী-ব্যবসায়ীর স্ত্রী-সন্তানরা আগে থেকেই বসবাস করছেন কানাডায়। গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে গেছেন। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন কানাডার বেগমপাড়ার অনেক সাহেব ও বেগম। পতিত শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের পাচার করা প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার খোঁজে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কানাডায় হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে বিলাসবহুল গাড়ি, বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তারা। তথ্য বলছে, প্রায় ৮০ হাজার বাংলাদেশি কানাডায় বাস করেন। যার মধ্যে প্রায় ১৩ হাজারই থাকেন টরন্টোতে। টরন্টো থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের স্কারবরোতে বিশ্বের অবৈধ সম্পদশালীরা বসবাস করছেন। কারণ এখানে বাড়ির মালিক হওয়া খুব সহজ, শুধু কোটি কোটি ডলার থাকলেই চলে। আর সেখানে মালিক হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ প্রবণতা আরও বেড়েছে।

বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদের কানাডায় বড় ব্যবসা ও বিলাসবহুল বাড়ি আছে। কারও আছে একাধিক বাড়ি। এই রাজনীতিবিদদের টাকা কানাডায় নিয়ে যাওয়ার কৌশল ভিন্ন। প্রথমে দেশ থেকে টাকা হুন্ডির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে নেওয়া হয়। পরে সেই টাকা মধ্যপ্রাচ্যে আয় দেখিয়ে কানাডার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নেওয়া হয়।

বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদের আওয়ামী লীগ দলীয় নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল তাদের একজন। স্কারবরো শহরে বিলাসবহুল ৭৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের বাড়িটি কিনেছেন সাবেক এই এমপি। সেখানে তার স্ত্রীর নামে রয়েছে আরও একটি বাড়ি। ২০১৩ সালের সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হওয়ার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি শিমুলকে। ২০১৩ সালে নির্বাচনি হলফনামায় দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে শিমুলের নগদ ১৩ লাখসহ মোট সম্পদ ছিল ৫১ লাখ টাকার। পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালের হলফনামায় দেখা গেছে তার সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকায়। ওই সময় পর্যন্ত শিমুলের স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতিও হয়েছেন প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। পুরো অর্থই নিয়ে গেছেন কানাডায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল টরন্টো থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের স্কারবরো এলাকার ক্যানস্কট রোডের ১৭ নম্বর বাড়িটি কিনেছেন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহসভাপতি আবির হাসান তানিম। এর মালিকানায় রয়েছেন তার স্ত্রী শরমিলা সিজানা। কোনো ধরনের ব্যাংক ঋণ অথবা মর্টগেজ ছাড়াই ১৫ লাখ ৫০ হাজার কানাডিয়ান ডলারের পুরোটাই পরিশোধ করা হয়েছে নগদে। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৫ কোটি। এর বাইরে দলিল খরচ দিতে হয়েছে আলাদা।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুব-উল আলম হানিফের স্ত্রী, দুই ছেলে ফাহিম আফসার আলম, ফারহান সাদিক আলম ও মেয়ে তানিশা আলম কানাডার ‘বেগমপাড়া’ হিসেবে পরিচিত নর্থ ইয়র্কের ‘বে ভিউ ভিলেজ’ এলাকায় বসবাস করেন। ছাগলকান্ডে অবসরে যাওয়া এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানের মেয়ে ফারজানা রহমান ইপসিতার বাড়ি রয়েছে কানাডার ব্যারি সিটিতে। চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি ৮ লাখ ৮৮ হাজার কানাডিয়ান ডলারে বাড়িটি কেনেন তিনি। এ সময় রেজিস্ট্রেশন ও জমি ট্রান্সফার ফি বাবদ আরও প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কানাডিয়ান ডলার খরচ হয়েছে। অর্থাৎ বাড়িটির মালিক হতে ইপসিতাকে খরচ করতে হয়েছে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ থেকে উন্নত দেশে আয়েশি জীবনযাপনের খবর নতুন নয়। সেই ধারাবাহিকতায় হানিফ, শিমুল ও তানিম কয়েকটি নামমাত্র। কিন্তু এভাবে কত হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে সেই হিসাব এখনো অজানা। বছরের পর বছর ধরে এভাবে অর্থ পাচার হলেও দেড় দশকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন ওইসব মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ী।

গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর ২০২০ সালের নভেম্বরে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনও কানাডায় অর্থ পাচারের খবর নিশ্চিত করেন। ওই সময় তিনি একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা টাকা পাচারের সত্যতা পেয়েছি। টাকা পাচারের ২৮টি ঘটনার তথ্য পেয়েছি, যেগুলোর মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি। আমরা জানতে পেরেছি, কেবল ঋণখেলাপি, ব্যবসায়ীরাই নন, অনেক সরকারি কর্মকর্তাও বেগমপাড়ায় ঠিকানা তৈরি করে নিয়েছেন’। জানা গেছে, কানাডা সরকার এ পর্যন্ত ২০০ বাংলাদেশি অর্থ পাচারকারীর সন্ধান পেয়েছে, কিন্তু তথ্য প্রকাশ করেনি। সেখানে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিদের হিসাবে এ সংখ্যা হাজারের বেশি। টরন্টোর বেলভিউ স্কয়ার পার্ক এলাকায় বিলাসবহুল হাইরাইজ কন্ডোমিনিয়াম, টরন্টোর প্রাণকেন্দ্র সিএন টাওয়ারের আশপাশে, টরন্টোর পাশের শহর রিচমন্ড হিলের আপস্কেল হোম, মিসেসাওগা এবং মার্কহামের অভিজাত এলাকায় বাস করেন এসব বাংলাদেশি। অন্টারিও এলাকায় এমন অনেক বেগমপাড়া রয়েছে বলে জানিয়েছেন কানাডা প্রবাসী সাংবাদিকরা। তারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা নিয়মিত টরন্টোতে বাংলাদেশের  অনেক (সাবেক) মন্ত্রী ও এমপি এবং রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীকে দেখি। কারও কারও কাছে শুনি তাদের ছেলে-মেয়েরা এখানে পড়ালেখা করছেন। আবার অনেকের পরিবারের অন্য সদস্যরা এখানেই থাকছেন। অনেককেই দেখি মাত্র কয়েকদিন আগে এসেছেন, বিশাল বাড়ি কিনেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র জানায়, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা প্রশাসন ক্যাডারের ৪৯ কর্মকর্তার দেশে-বিদেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের খোঁজ নিয়ে তাদের নামে-বেনামে অস্বাভাবিক সম্পদ পেয়েছেন, যা তাদের বৈধ আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। দেশে-বিদেশে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনের বাইরে পুলিশ, কাস্টমসসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও। এদের অনেকেই কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করেছেন। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির হিসাবে, ২০১৫ সালে বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬ বিলিয়ন (৬০০ কোটি) ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। জাতিসংঘের সংস্থা আঙ্কটাডের হিসাবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের করের ৩৬ শতাংশই পাচার হয়।

সর্বশেষ খবর