পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহমেদের প্রেতাত্মারা এখনো সক্রিয়। পুলিশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে তারা বহাল তবিয়তে। এখনো তাদের অনেকের পরামর্শেই চলছে পুলিশের মতো সবচেয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ এই বাহিনী। অথচ পুলিশের এই কর্মকর্তারাই বেনজীর আহমেদের ভয়াবহ দুর্নীতিতে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। নিজেরাও গড়েছেন দুর্নীতির পাহাড়। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের সময়ে কিছুদিনের জন্য তাদের কেউ কেউ ঢাকার বাইরে যাওয়ায় তারা এখন নিজেদের উপস্থাপন করছেন বঞ্চিত হিসেবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বোতলেই ঢুকছে পুরনো মদ। বেনজীরের লোক বলে পরিচিত এসব কর্মকর্তা ৫ আগস্টের পর অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের ‘বঞ্চিত’ বলে জাহির করারও চেষ্টা করেন। জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। এসব গুলির ঘটনায় শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত ১ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। আন্দোলনে গুলি চালিয়ে লাশ ফেলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছেন শতাধিক পুলিশ সদস্য। একটি সংস্থার প্রতিবেদনেও এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাইওয়ে পুলিশের প্রধান ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত আইজিপি শাহাবুদ্দিন খান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের পলিসি মেকারদের সঙ্গে একযোগে কাজ করেছেন। হাইওয়ে পুলিশকে সরাসরি গুলি করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বেনজীর আহমেদের কাছের লোক হিসেবেই তিনি বিগত সরকারের সময়ে পদোন্নতি ও পদায়নে সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী ছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিআইজি পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, অনেক সিনিয়র-জুনিয়র কর্মকর্তা নানাভাবে সাবেক আইজিপি বেনজীরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পরবর্তী আইজিপি (সাবেক) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের সময় তারা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়িত ছিলেন। নানা কায়দায় তারা বর্তমান সময়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এলিট ফোর্সের মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন ১৫ ব্যাচের অতিরিক্ত আইজিপি ব্যারিস্টার মো. হারুন অর রশিদ। র্যাবে দায়িত্ব পালনের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র অন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে র্যাবকে ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি গুলিবর্ষণ ও অন্যান্য বল প্রয়োগের নির্দেশনার বিষয়ে খবর প্রচার না করতে গণমাধ্যমকে হুমকি দেন তিনি। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিয়োগবাণিজ্যে সিন্ডিকেটের সরাসরি নেতৃত্ব দেন এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর ঘুষ গ্রহণ করে মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগবঞ্চিত করেন। এর বাইরেও পুলিশ সদর দপ্তরে আইসিটি শাখায় কর্মকালীন কেনাকাটা এবং সফটওয়্যার নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, বেনজীরের আরেক কাছের লোক রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি দেবদাস ভট্টাচার্য। রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি হিসেবে কর্মকালে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা রুজু, গ্রেপ্তার, রিমান্ডে এনে অত্যাচারের জন্য সব এসপিকে প্রচ চাপ প্রয়োগ করে বেআইনি কার্যক্রম সম্পাদনে বাধ্য করতেন। সূত্র জানায়, এপিবিএন-এর প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন ১৫ বিসিএস-এর অতিরিক্ত আইজিপি সেলিম মো. জাহাঙ্গীর। ডিআইজি হিসেবে দীর্ঘদিন এনএসআইতে কাজ করেছেন। একই সঙ্গে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কাজ করেছেন। এপিবিএনএর প্রধান হিসেবে ফোর্সকে ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে নির্দেশনা দিয়েছেন। বেনজীর আহমেদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এই কর্মকর্তাও গোপালগঞ্জের প্রভাব খাটিয়ে আসছিলেন। পুলিশের ১৭ ব্যাচের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বশির আহম্মদ। পুলিশ টেলিকমের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বর্তমানে সুপারনিউমারারি অতিরিক্ত আইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত। বিগত সরকারের সময়ে পদোন্নতি ও পদায়নে সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী। পুলিশের ১৭ ব্যাচের স্বঘোষিত এডিশনাল আইজিপি মো. মীজানুর রহমান। আরআরএফ পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অবৈধ ব্যবসার অভিযোগ এবং ভূমিদস্যু হিসেবে জমি দখলের অভিযোগে বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার বাসিন্দা হওয়ার কারণে অবৈধ প্রভাব বিস্তার করে চাকরি বিধিমালাকে পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা গ্রহণের চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, ১৮ বিসিএসের ডিআইজি রেজাউল হায়দার কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের ডিআইজি হিসেবে কর্মরত। ১৮ বিসিএসের কর্মকর্তা পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (প্রশাসন) আমিনুল ইসলাম। বেনজীর আহমেদের সময়ে তার সিন্ডিকেটের অন্যতম কান্ডারি। সঙ্গে ছিলেন একই ব্যাচের ডিআইজি আমেনা বেগম। স্পেশাল ব্র্যাঞ্চে থেকে বেনজীরের নির্দেশনা নিপুণভাবে বাস্তবায়ন করে গেছেন। ডিআইজি আজাদ মিয়া এবং শ্যামল কুমার নাথ ও বেনজীরের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম। তাদের দুজনই কক্সবাজারের সাবেক এসপি। বেনজীর আইজিপির দায়িত্ব নেওয়ার পর তাকে পরিচালিত করেছেন ২০ ব্যাচের অন্তত ১০ কর্মকর্তা। সব অপকর্মের অন্যতম প্রধান সিপাহসালার এবং পরামর্শদাতা হিসেবে এরাই ছিলেন সম্মুখভাগে। এই ব্যাচের ডিআইজি মোস্তাক আহমেদ খান এখন এপিবিএন-এ, সিলেট মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার এবং সাবেক ডিআইজি বরিশাল রেঞ্জ ইলিয়াছ শরীফ বর্তমানে এটিইউতে। রাজশাহী মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আনিসুর রহমান, খুলনা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি মইনুল হক, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নূরুল ইসলাম ছিলেন বেনজীরের ঘনিষ্ঠ। বেনজীরের অপকর্মের সাক্ষীদের অন্যতম ২৪ বিসিএস-এর আইয়ুব হোসেন। সে সময় তিনি এআইজি (পিআইও) হিসেবে বেনজীরের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেন। অন্যতম সহযোগী ছিলেন রিক্রুটমেন্ট অ্যান্ড ক্যারিয়ার প্লানিং-২, পারসোনাল ম্যানেজম্যান্ট-২, মোহাম্মদ আমজাদ হোসাইন অতিরিক্ত ডিআইজি সুনন্দা রায়। ২১ বিসিএসের অতিরিক্ত ডিআইজি শ্যামল কুমার মুখার্জি, ২২ বিসিএসের অতিরিক্ত ডিআইজি খোন্দকার নূরুন্নবী, সঞ্জিত কুমার রায়, আবিদা সুলতানা সব সময়ই বেনজীর আহমেদের গুড বুকে ছিলেন। ২৪ বিসিএসের কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দারের দাপটে রীতিমতো তটস্থ থাকত পুলিশের কর্মকর্তারা। বেনজীরের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুরের সাবেক এসপি গোলাম মোস্তফা রাসেল, গোপালগঞ্জের সাবেক এসপি আল বেলী আফিফা, গাজীপুরের সাবেক এসপি এবং এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামের ভায়রা কাজী শফিকুল আলম, সাবেক এআইজি মাল্টিমিডিয়া এবং শেরপুর ও জামালপুরের সাবেক এসপি মো. কামরুজ্জামান অন্যতম। নাম রয়েছে একই ব্যাচের ঢাকা জেলার সাবেক এসপি মো. আসাদুজ্জামানের।
তবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ৩০ তম বিসিএসের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহেদা সুলতানার নাম বারবার উঠে এসেছে। তিনি বেনজীরের স্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। বেনজীর যখন র্যাবের ডিজি ছিলেন তখন শাহেদা র্যাবে ছিলেন। আইজিপি হলে শাহেদা আইজিপির সেকশনে আইজিপির স্ত্রীর প্রটোকল অফিসার হিসেবে যোগ দেন। পরে যখন বেনজীর আইজিপি পদ থেকে অবসর নেন তখন তাকে আবার র্যাব সদর দপ্তরের অপারেশন উইংয়ে সিনিয়র সহকারী পরিচালক (অপস) হিসেবে পোস্টিং দেওয়া হয়। বেনজীর যখন দেশ ছেড়ে চলে যান, তখন তিনি র্যাবে কাজ করা সত্ত্বেও নিজের প্রভাব খাটিয়ে বেনজীরকে ইমিগ্রেশন পার হতে সাহায্য করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, পুলিশে মৌলিক সংস্কার এখন সময়ের দাবি। কোনো দলের লাঠিয়াল হিসেবে নিজেদের সঁপে দেওয়া উচিত হবে না এই বাহিনীর সদস্যদের। পুলিশ রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য, এটা উপলব্ধি করতে হবে। উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়াগুলো যদি অনুসরণ করা যায় তাহলে জনগণের মধ্যে পুলিশ নিয়ে স্বস্তি ফিরবে।
প্রঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র হত্যার অভিযোগে সাবেক আইজিপি শহীদুল হক ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদেও তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞে সরাসরি অংশ নেওয়া ও নেতৃত্বদানকারী ৯৫ জন পুলিশ সদস্যের নামে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় ২৮৪টি মামলা করা হয়েছে। গত ১৩ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত এসব মামলা করা হয়। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানায় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ৯১টি। সম্প্রতি কয়েকজন মাস্টারমাইন্ড পুলিশ সদস্যকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        