বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, আওয়ামী লীগ যে পরিমাণ অপকর্ম করেছে তাতে আগামী ১০০ বছর তাদের আর ক্ষমতায় আনবে না দেশের জনগণ। গত ১৫ বছর যার নেতৃত্বে দেশে এতসব অপকর্ম হয়েছে সেই শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে পারলে আমাদের অন্তরের জ্বালা মিটবে। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ন্যায়বিচারের দু-একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। এই বিএনপি নেতা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনি রোডম্যাপ প্রকাশ করা, নইলে জনগণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিএনপির প্রত্যাশা কী-জানতে চাইলে সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, সব স্বাধীনতাকামী ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমন্বয় করে, তাদের মতামত নিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা তারা করবে এটিই আমাদের মূল প্রত্যাশা। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে আমলা ও পুলিশের প্রভাবমুক্ত করার যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে তা অক্ষুণœ রাখতে হবে। গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ যে নির্মমতার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে, অর্থ পাচার করেছে, বিচার বিভাগসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে, দুদককে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে তারই প্রতিফলন ঘটেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে।
নোয়াখালীর এই সাবেক সংসদ সদস্য বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে যে পরিবেশ প্রয়োজন সে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কিন্তু সে পরিবেশ সৃষ্টি করা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন জনগণের ভোটে নির্বাচিত দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সরকার।
জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, আওয়ামী সরকারের আমলে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর অবস্থা ছিল চরম দুর্দশাগ্রস্ত। বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া যখন শেখ হাসিনা হাতে নেন তখনো বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ৩১ দফা, ২৭ দফা দিয়েছেন। আজ অন্তর্বর্তী সরকার যেসব বিষয় নিয়ে সংস্কারের কথা ভাবছে, বিএনপি বহু আগেই এসবের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। আমাদের নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, দুবারের বেশি কারও প্রধানমন্ত্রী থাকা উচিত না, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ থাকা উচিত। মনের শক্তি এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার জোরেই তিনি এসব কথা বলতে পেরেছেন। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে যোগ্যতাবলেই তিনি রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মী অবর্ণনীয় নির্যাতন-হয়রানির শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, আওয়ামী স্বৈরশাসনামলে আমি অনেক হয়রানিমূলক মামলার শিকার হয়েছি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১১১টি মামলা দেওয়া হয়েছে। গত ১৫ বছরের মধ্যে অনেক বছর জেলে কাটিয়েছি, অনেক মামলায় হাজিরা দিতে হয়েছে। দলের ৯৬ লাখ নেতা-কর্মী বিভিন্ন মামলার আসামি। কোর্টে হাজিরা দিতে দিতে তাদের জীবন ক্ষয় হয়েছে, অনর্থক অর্থ ব্যয় হয়েছে, পরিবার ভেঙে পড়েছে। মোট কথা বিএনপির সবকিছু গত ১৫ বছরে শেষ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এসব অপকর্ম যার নেতৃত্বে হয়েছে সেই শেখ হাসিনাকে যখন বিচারের মুখোমুখি করা হবে তখন আমাদের অন্তরের জ্বালা মিটবে। এসব যন্ত্রণা আর তখন মনে থাকবে না।
ফারুক আরও বলেন, ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত অগণতান্ত্রিকভাবে বিনা ভোটে যেসব এমপি সংসদে গিয়েছেন তাদের বেশির ভাগকেই এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাদের বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ। এদের আইনের আওতায় আনলেই দেশের জনগণ স্বস্তি পাবে। জনগণ মনে করবে এ সরকার প্রকৃত অর্থেই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শন প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে বললে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, আওয়ামী লীগের দর্শন ছিল ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার।’ তারা এ নীতিতে বিশ্বাসী। অনেক সময় হাই কোর্টে দেখেছি বিচার তাদের পক্ষে যায়নি বলে এজলাসে লাথি মারতে, হাই কোর্টের সামনে ময়লা ফেলতে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হলো বিচার বিভাগ। সেই বিচার বিভাগকেও তারা দলীয় নিয়োগ দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। আওয়ামী দুঃশাসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন।
বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, আওয়ামী লীগ রাজনীতি করুক, এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে আমার প্রত্যাশা এমন আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে আসুক যারা শেখ হাসিনার মতো নেতার নেতৃত্বে আরও একবার সন্ত্রাসী লীগ কায়েম করবে না, ক্ষমতায় এসে লুটপাট করবে না। আওয়ামী লীগ কিন্তু জামায়াতের চেয়েও খারাপ কাজ করে গেছে। তারা একদলীয় বাকশাল কায়েম করতে গিয়ে বিরোধী দলগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করেছিল। তারই প্রমাণ হিসেবে শেষ বেলায় এসে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছে।
ফারুক বলেন, জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় অখ পাকিস্তানের পক্ষে থাকলেও পরে বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিজেদের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি দাবি করলেও কাজ করেছে স্বাধীনতাবিরোধীদের মতো। দলীয়করণ করেছে, বাকশাল করেছে, সংবাদপত্র বন্ধ করেছে, সাংবাদিক গ্রেপ্তার করেছে, সাগর-রুনির হত্যাকারীদের বিচার করেনি, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, বিদেশে বাড়ি-গাড়ি-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করেছে। এরা আবারও আওয়ামী লীগের রাজনীতি করবে এটা মানুষ গ্রহণ করবে না। সরকার কী করবে জানি না, তবে জনগণ ইতোমধ্যে বলা শুরু করেছে আওয়ামী লীগকে আগামী ১০০ বছর তারা আর ক্ষমতায় আনবে না।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার প্রসঙ্গে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে। প্রসিকিউশন তৈরি হয়েছে। তার বিচার অবিলম্বে সরকার শুরু করবে। জনগণের প্রত্যাশা এবং তাদের পাশাপাশি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমারও চাওয়া এ সরকার ন্যায়বিচারের দু-একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করবে। তবে শেখ হাসিনা তো এখন ভারতে আশ্রিত। কোনো একটি পত্রিকায় আমি দেখেছি, তারা লিখেছে-চীনের এক দালাই লামাকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে, শ্রীলঙ্কার কাউকে কাউকে আশ্রয় দিয়েছে। শেখ হাসিনাকেও বন্ধু মনে করে ওয়ান-ইলেভেনের সময় এবং শেখ মুজিব হত্যার পর ভারত তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশে নানাবিধ অপকর্ম ঘটিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর এবারও তাঁকে তারা আশ্রয় দিয়েছে। ৪৫ দিনের বৈধ মেয়াদও শেখ হাসিনার শেষ হয়ে গেছে। এখন তিনি সেখানে উদ্বাস্তু। ২০১৩ সালে ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা বন্দিবিনিময় চুক্তি করেছেন। সেই চুক্তি অনুসারে অনতিবিলম্বে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে হবে। ভারত যদি এ চুক্তির মর্যাদা রাখে তবে শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর তাদের করতেই হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পেছনে বিএনপির ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের এই উপদেষ্টা বলেন, বিএনপির ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। অভ্যুত্থানে নিহত ৮০০-এ মধ্যে ৪৭২ জন ছিলেন বিএনপির নেতা-কর্মী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে আমি সালাম জানাই। যারা শহীদ হয়েছেন আল্লাহ তাদের বেশেহত নসিব করুক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণেই শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তারা তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে মাঠে নামার সঙ্গে সঙ্গে দেশনায়ক তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপি নেতা-কর্মীরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এ ছাড়া ১৫ বছর ধরে যারা আওয়ামী নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারাও ছাত্র-জনতার পক্ষে মাঠে নেমেছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যেসব রাজনৈতিক দল একসঙ্গে আন্দোলন করেছে তাদের নিয়ে বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে এই বিএনপি নেতা বলেন, গত ১৫ বছরে যে দেশপ্রেমিক দলগুলো বিএনপির সঙ্গে কাজ করেছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, যদি কোনো দিন এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে আমরা আন্দোলনরত সব দলের সঙ্গে একত্রে কাজ করব। নির্বাচনি প্রক্রিয়া শুরু হলেই বোঝা যাবে বিএনপি কার কার সঙ্গে জোট করবে। আশা করছি, আন্দোলনে যারা আমাদের সঙ্গে ছিল তারা সবাই আমাদের সঙ্গে থাকবে। এক প্রশ্নের উত্তরে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনি রোডম্যাপ প্রকাশ করা। নইলে জনগণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে।
জামায়াতে ইসলামী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জামায়াত আমাদের রাজনৈতিক বন্ধু ছিল। একসঙ্গে আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগ নেই, এখন জামায়াতও নতুন উদ্যমে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেছে। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতিই বলে দেবে, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেমন হবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বিএনপি চেয়ারপারসনের এই উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার নীতিতে। কারও সঙ্গে আমাদের বৈরিতা কাম্য নয়। গণতান্ত্রিক এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে দলই ক্ষমতায় আসুক নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশকে উন্নয়নের শীর্ষে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
দলের তৃণমূলের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সম্পর্কে এই বিএনপি নেতা বলেন, ছোটখাটো দু-একটা রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ঘটতেই পারে। এর বিরুদ্ধে অ্যাকশনও দল নিচ্ছে। বিএনপি এমন একটি রাজনৈতিক দল যার প্রথম নেতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, এরপর বেগম খালেদা জিয়া, এরপর তারেক রহমান। এমন নেতৃত্বের অধীনে কেউ সন্ত্রাস করবে, লুটতরাজ করবে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। দু-একটা ছোটখাটো দোষত্রুটি থাকতে পারে। বৃহৎ আকারে সমস্যা তৈরি করার মতো কোনো ঘটনা আমার চোখে পড়েনি।
দলের সম্মেলন বিষয়ে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, আওয়ামী লীগ আমাদের এত বছর সম্মেলন করার সুযোগ দেয়নি। ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো একে একে প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। তিনি দেশে ফিরে আসবেন, দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে বসবেন, তারপর রয়েছে নির্বাচন। নির্বাচনের তারিখের ওপর নির্ভর করে সম্মেলনের বিষয়ে দলের হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নেবেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাসের কার্যক্রম সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে বললে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, মূল্যায়ন-অবমূল্যায়নের সময় এখনো আসেনি। লেট আস ওয়েট অ্যান্ড সি।