কাল ৫ নভেম্বর পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ নির্বাচনের দিকে গোটা বিশ্ব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। নির্বাচনি ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বনেতাদের সম্পর্ক কোন দিকে গড়াবে। একই সঙ্গে নির্ভর করছে বিশ্ব রাজনীতির অবস্থানও। এদিকে গতকাল পর্যন্ত জনমত জরিপগুলো নিশ্চিত করতে পারেনি যে- ভোট যুদ্ধে রিপাবলিকান নেতা ডোনান্ড ট্রাম্প বিজয়ী হবেন, না ডেমোক্র্যাট নেতা কমলা হ্যারিস বিজয়ী হবেন। কারণ উভয়েই সমানে সমান অবস্থানে আছেন। এদিকে হোয়াইট হাউসে যাওয়ার দৌড়ে পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ছেন কমলা ও ট্রাম্প। ৫ নভেম্বর নির্বাচনের দিন হলেও যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আগাম ভোট গ্রহণ আগেই শুরু হয় এবং গত শনিবার রাত ৯টা নাগাদ প্রায় ৮ কোটি ভোট (সশরীরে কেন্দ্রে এবং ডাকযোগে) জমা পড়েছে। এ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর মার্কিন গণতন্ত্রের গতি-প্রকৃতি নির্ধারিত হবে। তথ্য-প্রযুক্তির জগতে যুক্তরাষ্ট্রের মুরুব্বিয়ানার সীমা-পরিসীমা সম্পর্কেও জানা যাবে। সবচেয়ে বড় কথা এ নির্বাচনে ইতিহাস তৈরি হবে- হোয়াইট হাউসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট অধিষ্ঠিত হলে, অথবা নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দিতে ক্যাপিটল হিলে জঙ্গি হামলাসহ গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ ব্যক্তি আবারও হোয়াইট হাউসে অধিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলে ফৌজদারি আদালতে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি কারাগারের পরিবর্তে বিশ্বনেতার মুকুট পরিহিত হবেন বলে রাজনৈতিক ও সমাজ-বিশ্লেষকেরা মন্তব্য করছেন। কমলা এবং ট্রাম্প উভয়েই নিজের বিজয় নিশ্চিতের জন্য শেষ পর্যায়ের সভা-সমাবেশ করছেন। পাশাপাশি আগের মতো বিভিন্ন সংস্থার জরিপেও উঠে আসছে জয়-পরাজয়ের নানা আভাস। যদিও গত কয়েকটি নির্বাচনে জরিপের ফলাফল শতভাগ সত্য হয়নি, তবুও প্রার্থীদের উজ্জীবিত রাখতে জরিপগুলো অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে। সর্বশেষ জরিপে রিপাবলিকান স্টেট আইওয়াতে ট্রাম্পের চেয়ে কমলা এগিয়ে গেছেন। আইওয়ায় ২৮ থেকে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে পরিচালিত ডে মইন রেজিস্টার ও মিডিয়াকমের জরিপে ৮০৮ জন সম্ভাব্য ভোটার অংশ নেন। তাদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ হ্যারিসের পক্ষে ও ৪৪ শতাংশ ভোটার ট্রাম্পের পক্ষে সমর্থন জানান। এই জরিপে সম্ভাব্য গ্রহণযোগ্য ভুলের মাত্রা ধরা হয়েছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এর আগে সেপ্টেম্বরে আইওয়ায় পরিচালিত আরেকটি জরিপে ট্রাম্প ৪ পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন বলে ডে মইন রেজিস্টার সংবাদপত্র জানিয়েছে। ধারণা করা হয়, এ স্টেটে যে প্রার্থীই জয়ী হবেন অঙ্গরাজ্যের ছয়টি ইলেকটোরাল ভোট তার পক্ষে যাবে।
নানাভাবে বিতর্কিত এবং সমালোচিত ট্রাম্পকে ধরাশায়ী করা নিয়ে ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিসের কেন এত দুশ্চিন্তা? কেন আমেরিকানদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় ঘটছে না সামগ্রিক অর্থে? কেন ট্রাম্পের বিজয়ের সম্ভাবনা ক্রমে জোরালো হচ্ছে? ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে মানুষের ভুলো মনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বের কয়েকটি দেশের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবির জের পড়তে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও-এমন একটি ধারণা পেয়ে বসেছে অনেকের ভিতর। তাদের ধারণা ভোটারেরা পরিবর্তনে প্রত্যাশী। নতুন কিছু পেতে চান সবাই। এর উদাহরণ হচ্ছে ব্রিটেন, জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপান। ক্ষমতাসীন পার্টি জয় পায়নি এসব দেশের সর্বশেষ নির্বাচনে। চার বছর আগেও ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজিত হয়েছেন। ফ্রেঞ্চ এবং কানাডার নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনরা জয়ী হবেন- তা অনেকে ভাবছেন না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে এমন আশঙ্কা সঠিক হয়েছে বলে শোনা যায়নি। তবে করোনার ধাক্কা সামলে নেওয়ার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তথা ডেমোক্রাটদের প্রতি সচেতন আমেরিকানরা সন্তুষ্ট নন এবং কমলা হ্যারিস বাইডেনের কর্মসূচিকেই প্রাধান্য দেওয়ার কথা আকারে-ইঙ্গিতে বলছেন বলে ট্রাম্পের বিজয় ত্বরান্বিত হতে পারে- ভাবনা ভোটারের বড় একটি অংশের। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতা এবং সীমান্তকে ওপেন করে ২২ লক্ষাধিক বিদেশিকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে পড়ার অবিশ্বাস্য সুযোগ তৈরির খেসারত দিতে হচ্ছে কমলাকে- এমন মতামত অনেক জরিপে প্রকাশিত হয়েছে। ট্রাম্প আমলে অর্থনৈতিক অবস্থা গুরুত্ব পাচ্ছে স্বল্প ও মাঝারি আয়ের ভোটারের কাছে। বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের সর্বশেষ বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আমেরিকার উদ্যমী উদ্যোক্তার ভোট যে প্রার্থী বেশি পাবেন, তার ভাগ্যেই জুটবে বিজয় মুকুট। এক্ষেত্রে ৪০ বছরের কম বয়সি যুব সমাজের মনোভাব উপস্থাপনকালে ম্যাগাজিনটি বলেছে যে, গত নির্বাচনে জো বাইডেন এই শ্রেণির পুরুষ ভোটারের সমর্থন পেয়েছিলেন। এবার সে চেষ্টা করছেন কমলা হ্যারিস। কিন্তু বাইডেনের দুর্বল এবং সিদ্ধান্তহীন অনেক পদক্ষেপে স্বনির্ভরতায় বিশ্বাসী পুরুষ যুবকেরা কমলার প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না। তারা সুন্দর কথার ফুলঝুরিতে আটকে থাকতে চান না, রাজনৈতিক মতামতেও তেমন বিশ্বাসী নন। তারা চান ভাগ্য পরিবর্তনে আন্তরিক সহযোগিতার অঙ্গীকার- যা ট্রাম্প এখনো করতে পারেননি। এই বয়সি ভোটারকে উজ্জীবিত করে কেন্দ্রে নিতে আগ্রহী হওয়া প্রার্থীর বিজয় সহজ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই শ্রেণির ভোটারের হৃদয় জয়ের অভিপ্রায়ে নর্থ ক্যারোলিনার গ্রিনসবরো সিটিতে শনিবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যতিক্রমী বক্তব্য রেখেছেন। প্রায় ৯০ মিনিটের ভাষণে ট্রাম্প ‘আমেরিকানদের স্বপ্ন’ ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেন, যে কোনো দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সমাবেশ আমি করেছি। ট্রাম্প, ‘আমেরিকা এখন একটি অধিকৃত দেশ’ এবং আসন্ন নির্বাচনকে ‘মুক্তির দিন’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি জানান, যদি তিনি আবার ক্ষমতায় আসেন, তাহলে মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং ‘কমলার আমেরিকান জ্বালানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বন্ধ করবেন। তার ভাষায়, ‘আমরা জ্বালানি উত্তোলন করব।’
এরপর জনগণকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ট্রাম্প বলেন, যখন আপনি অনেক এগিয়ে থাকেন, তখনো একটু ব্যবধানে হেরে যেতে পারেন। তিনি জনতাকে বলেন, আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ এখন আপনার হাতে। আপনি কমলাকে জানাবেন যে, আপনাদের ধৈর্য শেষ, আপনি (কমলা) দেশের ক্ষতি করেছেন। কমলা, আপনি বরখাস্ত।
অন্যদিকে নর্থ ক্যারোলিনারই শার্লট সিটিতে একইদিন এক সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কমলা হ্যারিস ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘অস্থিতিশীল এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের ঝোঁক থাকা একজন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কমলা বলেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে তার ‘শত্রু তালিকা’র ওপরই মনোযোগ দেবেন। তিনি ভিন্নমত পোষণকারীদের শত্রু মনে করেন। এর বিপরীতে কমলা বলেন, ‘আমি এমন এক নেতৃত্বের অনুসারী, যেখানে বিরোধীদেরও মত প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হবে। এটাই প্রকৃত নেতৃত্ব।’
এ সমাবেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে কমলা একটি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নেরও ঘোষণা দেন, যার মধ্যে রয়েছে ১০ কোটিরও বেশি আমেরিকানের জন্য কর কমানো, খাদ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন এবং সবার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা। কমলা বলেন, ‘আমার প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে জীবনযাত্রার খরচ কমানো।’
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ প্রসঙ্গে কমলা বলেন, আমরা সবাই চাই মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধ হোক এবং বন্দিরা ঘরে ফিরে আসুক। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি এই বিষয়গুলোতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।
নারী অধিকার নিয়েও কমলা তার অবস্থান পরিষ্কার করেন। তিনি বলেন, এই নির্বাচন মূলত স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম, যাতে নারীরা তাদের শরীর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এই নির্বাচনে আপনারাই পার্থক্য গড়ে দেবেন।