ভারতের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আর এই ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আজ (গতকাল) সন্ধ্যায় আমাদের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বসছেন। আগামীকাল (আজ) বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসবেন। পরদিন তিনি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে বসবেন।’ প্রেস সচিব বলেন, এই মিটিংয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে তিনি জাতীয় ঐক্যের ডাক দেবেন। ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে এই জাতীয় ঐক্যের ডাক- এমনটি জানিয়ে শফিকুল আলম বলেন, ‘ইদানীং কিছু ঘটনা নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এর জন্য ভারতীয় গণমাধ্যম দায়ী। ইন্ডিয়ান মিডিয়া খুব অ্যাগ্রেসিভলি এই কাজগুলো করছে। সেটার জন্য আমাদের একটা জাতীয়ভাবে ঐক্য তৈরি করে বলতে হবে, তোমরা আসো, দেখো- কী হচ্ছে। একই সঙ্গে আমাদের জাতীয় ঐক্যটাও ধরে রাখতে হবে।’
প্রেস সচিব বলেন, ‘আমাদের জাতীয় ঐক্য খুব জরুরি। কারণ আমাদের দেশকে নিয়ে একধরনের অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে, দেশের ইমেজকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই মিস ইনফরমেশন ক্যাম্পেইনের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের সবাইকে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে।’
তিনি দেশীয় গণমাধ্যমকে এই জাতীয় ঐক্যে সাড়া দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি আমার দেশের পত্রিকাগুলোকে আহ্বান করব তারা যেন বাংলাশেকে নিয়ে যে ভয়ানক ধরনের মিথ্য তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তারাও যেন এটি প্রতিরোধে কাজ করে।’ এটা একটা জাতীয় দায়িত্ব বলে মনে করিয়ে দেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব।
তিনি বলেন, আগস্টের শেষের দিকে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। তখন তিনি ভারতীয় গণমাধ্যমকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে সংখ্যালঘু ইস্যুতে কী ঘটছে, তা দেখে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা যে তথ্যগুলো নিচ্ছে নাম ও প্রমাণ ছাড়া। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কাউন্সিলের রিপোর্টের ভিত্তিতে তারা তথ্য প্রচার করছে। নেত্র নিউজ দেখিয়েছে যে বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কাউন্সিলের রিপোর্টটা ডিসটোরটেড। এই রিপোর্টে বড় রকমের গলদ আছে।
প্রেস সচিব বলেন, বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কাউন্সিলের রিপোর্টে ৯ জনের মৃত্যুর কথা আছে। এগুলো সহিংসতার কারণে হয়নি। এই মৃত্যুগুলোর পেছনে মূলত রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত কারণ ছিল। তাদের রিপোর্ট নিয়ে নেত্র নিউজ যে রিপোর্ট করল, সেটাকে কাউন্টার করার মতো একটা স্টেটমেন্টও দেয়নি বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কাউন্সিল। তারা এটাও বলেনি যে আমরা সেটা দেখি।
শফিকুল আলম বলেন, ‘বৈশি^ক হিউম্যান রাউটস অর্গানাইজেশনকেও আহ্বান জানাই, আপনারা আসেন, দেখে যান, বাংলাদেশে কী ঘটছে। কারও জন্য আমাদের দরজা বন্ধ হয়নি। আমরা উন্মুক্ত। আমাদের সমস্ত কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আছে। আমরা বারবার বলছি, তারপরও অনেকে আমাদের কথা শুনেও না শোনার ভান করছে।’
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বাংলাদেশের উপহাইকমিশনে যে হামলা হয়েছে, সে পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অবহিত করা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা কূটনৈতিক মাধ্যমে আমাদের প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমরা মনে করি, বাংলাদেশকে নিয়ে যে মিস ইনফরমেশন গ্যাপ, সেই গ্যাপের কারণে এসব ঘটছে। এটার (ভারতের জনগণকে খেপিয়ে তোলা) জন্য আমি দায় চাপাব ইন্ডিয়ান মিডিয়াকে। ভারতীয় গণমাধ্যম কোনো ধরনের চেকিং ছাড়াই মিথ্যাতথ্য ছড়াচ্ছে। এর ফলে ভারতীয় জনগণ বা একটা অংশ সহিংসতা করছে।’
প্রেস সচিব বলেন, ‘যারা যারা এগুলো করছে তাদের সঙ্গে কথা বলছি। আমাদের স্টেটমেন্ট দিচ্ছি। বাংলাদেশের সরকারের যে এক্সিটিং কাঠামো রয়েছে, এর চেয়ে বেশি কিছু করার নেই আমাদের।’ তবে দেশের নাগরিক সমাজ, প্রবাসী বাংলাদেশি, রাজনৈতিক দল সিভিল সোসাইটি তাদেরও এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব।
তিনি বলেন, ‘যে মেসিভ মিস ইনফরমেশন ছড়ানো হচ্ছে, তারা (ভারত) আমাদের চারদিক থেকে একটা কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চেষ্টা করছে।’
ভারতের হাইকমিশনার প্রণব ভার্মা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেখা করে বলেছেন, তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। ভারত সরকারের আচরণে কী মনে হয়েছে তারা সত্যি অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চায়? এক সাংবাদিক এই প্রশ্ন করলে শফিকুল আলম বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। ভারত আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী। তবে অবশ্যই এ সম্পর্ক হতে হবে ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে।’
শেভরণ গ্যাসকূপ খননে আগ্রহী : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মার্কিন কোম্পানি শেভরনের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠকের বরাত দিয়ে শফিকুল আলম জানান, কোম্পানিটি বাংলাদেশে আবার বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা নতুন করে দুটি গ্যাসকূপ খনন করতে চায়। ব্লক নম্বর ১০ ও ১১ যেটি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে অবিস্থত সেই দুটি কূপে অনুসন্ধান চালাবে।
প্রেস সচিব বলেন, কথিত স্বৈরাচার তাদের শেষ দুই বছরে শেভরনের একটি টাকাও দেয়নি। ফলে বড় একটি বকেয়া সৃষ্টি হয়েছে, যা কয়েক শ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে যে গ্যাস উৎপাদন হয় তার ৬০ শতাংশ শেভরনের নিয়ন্ত্রণে। শেভরণের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার একটি চুক্তি হয়েছে, যেখানে ছয় মাসের মধ্যে এই বকেয়া পরিশোধের শর্ত রয়েছে।
শফিকুল আলম বলেন, ‘গত সেপ্টেম্বর থেকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গ্যাসের চাহিদা তৈরি হয়েছে। ম্যানুফ্যাকচারিং, রপ্তানি খাত উজ্জীবিত হচ্ছে। অক্টোবরে রপ্তানির বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। নভেম্বরেও বাড়বে। একটি নতুন বিনিয়োগ নীতিমালাও করা হচ্ছে। বিডাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বৈশি^ক কোম্পানিগুলোও বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমাদের বিরাট একটা টিম আছে, যারা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কাজ করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা শেভরনকে আরও কূপ খননে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।’ প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার উপ প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ ও অপূর্ব জাহাঙ্গীর উপস্থিত ছিলেন।