আমার নিজের একটা দেশ হবে, এই ভেবেই আমরা মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার যুদ্ধে গিয়েছিলাম। স্বাধীন সেই দেশে নিপীড়ন-নির্যাতন থাকবে না। গণতন্ত্র থাকবে। ভোটের অধিকার থাকবে। একটা স্বাধীন দেশের যেসব উপাদান ও সুযোগসুবিধা থাকা উচিত সেগুলো কোনো ধরনের ভোগান্তি ছাড়া রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক উপভোগ করবে- এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মুখ্য বিষয়। আমরা যুদ্ধ করেছিলাম তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যে বৈষম্য চলছিল তার অবসানের জন্য। শাসনের নামে পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের শোষণ করত। তা থেকে মুক্তি পেতেই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অবশেষে আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি। দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েই যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় এলেন নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে দাবি করে সেই আওয়ামী লীগ বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর সময়কালের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সব চেতনাকে ধ্বংস করে দিল।
যেখানে গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক অধিকারের জন্য আমরা লড়াই করলাম সেখানে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে তারা দেশে একদলীয় শাসনের অবতারণা করল। সব পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে মাত্র চারটি পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হলো। রাষ্ট্রপরিচালনায় তাদের ব্যর্থতার কারণে জনগণ চরম দুর্ভোগে পড়ল। অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হলো। দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। না খেতে পেয়ে মানুষ মরতে থাকল। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগ সব সময় আধিপত্যবাদের শক্তির পক্ষেই কাজ করেছে। একটা স্বাধীন দেশের যে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, স্বাধীন সংস্কৃতি হবে, শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের সংস্কৃতি ফুটে উঠবে তার কোনোটিই তাদের কারণে হলো না। আমরা পিন্ডির থেকে দেশ স্বাধীন করলাম কিন্তু দেখা গেল দিল্লির অধীন হয়ে পড়লাম। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ব্যবসা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও ব্যবসা করেছে। আওয়ামী লীগের কারণে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন তো দূরের কথা, তাদের এখনো বিভিন্নভাবে সমাজে অবহেলিত ও নিগৃহীত হতে হয়। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের পরিবর্তে পরিবারতন্ত্রে বিশ্বাস করে। এ কারণেই বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। গত ১৫ বছরও তারা জনবিচ্ছিন্ন ছিল। এসব কারণেই নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগকে বিদায় নিতে হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো শাসক এভাবে বিদায় নেয়নি। শেখ হাসিনার পতন যেভাবে হয়েছে, সেটা তাঁর এবং জাতির জন্যও একটা দুর্ভাগ্য। এখান থেকে সবাইকে শিক্ষা নিতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের করণীয় একটিই, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। মানুষের মৌলিক অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য প্রতিষ্ঠা- এগুলোর একটাও আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ছিল না। যুদ্ধের পর হয়নি। নব্বইয়ের পট পরিবর্তনের পর মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল। মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখেছিল, হয়তো গণতন্ত্র ফিরে আসবে। কিন্তু হয়নি। আবার এতগুলো বছর পর এবার ৫ আগস্ট আরও একটি গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা বিদায় নিলেন। এখন মানুষ আবার আশা করছে, তারা হয়তো গণতন্ত্র ফিরে পাবে।
যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন থেকে আওয়ামী লীগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল বলেই বিএনপির জন্ম হয়েছিল। একাত্তরের ২৫ মার্চ আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল বলেই জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব। পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরের আগে এ দেশে গণতন্ত্র চরমভাবে বিঘিœত হয়েছিল, আমাদের স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে ৭ নভেম্বর আবারও শহীদ জিয়ার আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনি আসার পরে মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্ন, যে সাধ কিছুটা হলেও তিনি জনগণকে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ কারণেই বাংলাদেশের ইতিহাসে ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি ৭ নভেম্বরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। পঁচাত্তরের সেই ৭ নভেম্বর যদি না ঘটত তাহলে সে সময়ই আধিপত্যবাদের অপশক্তির করায়ত্বে দেশ চলে যেত।
স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়াউর রহমানের হাত দিয়েই দেশের মানুষ গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার ফিরে পেয়েছিল। তাঁর হাত ধরেই এ দেশের কৃষি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বৈদেশিক নীতির সংস্কার হয়েছিল। এমন কোনো ক্ষেত্র ছিল না যেখানে জিয়াউর রহমানের সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি। স্বাধীনতার পরে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ছিল আমাদের জন্য বিপদের কারণ। শেখ মুজিব এগুলোর চিত্র দেখিয়ে ত্রাণ আনতেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পরে জনসংখ্যাকে তিনি জনশক্তিতে রূপান্তর করেছিলেন। স্বাধীনতার যে মূল চেতনা সেটির স্বাদ জনগণ কিছুটা হলেও পেয়েছিল পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরের পরে। শহীদ জিয়াউর রহমান যেটির সূত্রপাত করে গিয়েছিলেন তার আলোকে তারেক রহমান যে ৩১ দফা দিয়েছেন, এর মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রকে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারব। মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে পারব। পরবর্তী সময়ে কোনো নির্বাচিত সরকার ফ্যাসিবাদের দিকে যেতে পারবে না, অর্থনীতির পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি আমরা কায়েম করতে পারব, যে সার্ক এখন মৃতপ্রায় বিএনপি ক্ষমতায় এলে সেই সার্ক আবার পুনর্জীবি হবে। মোটকথা, জনগণের চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই বিএনপির জন্ম হয়েছে, জনগণের চাহিদা, দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য যা যা করা দরকার বিএনপি তা করবে।
অনুলিখন : শরিফুল ইসলাম সীমান্ত