বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের নজিরবিহীন উত্তেজনার মধ্যেই আজ ঢাকা আসছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রী। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় প্রথমবারের মতো ভারতের কোনো সর্বোচ্চ কর্মকর্তা সফরে আসছেন। পূর্বনির্ধারিত সফর হলেও পরিস্থিতি এবার একেবারেই ভিন্ন। এতদিনের সম্পর্ক এখন নিয়েছে নতুন মোড়। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর ভিন্ন বাংলাদেশে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সফরে দুই দেশের পক্ষ থেকে কী বার্তা আসবে তা নিয়েই চলছে আলোচনা।
জানা যায়, বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম ঢালাওভাবে অপপ্রচার করে আসছে। ঢাকা-দিল্লি এমন টানাপোড়েনে ঘি ঢালে আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে দিনেদুপুরে হামলা ও জাতীয় পতাকা অবমাননার ঘটনা। তারপর ভারতীয় হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলবসহ নানা ঘটনায় বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায়। ইতোমধ্যে ভারতের কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রধানরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ঢাকায় ফিরে এসেছেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব আসছেন আমাদের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে। এটা স্ট্যান্ডিং মেকানিজম, অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রতি বছর আমাদের একজন যান ওপাশে, পরের বছর ওপাশ থেকে একজন আসেন। এটাকে কনসালটেশন বলা হয়, যা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। আমি আশা করব, তাঁরা একটা ফলপ্রসূ আলোচনা করবেন। তিনি বলেন, ভারত যদি আমাদের সবাইকে একসঙ্গে নিতে পারত তাহলে ভারতের সুবিধা হতো, আমাদেরও সুবিধা হতো। কিন্তু সেটা দুঃখজনকভাবে হচ্ছে না। ব্যবসাবাণিজ্যের ব্যাপারে ভারতের অবস্থান খুবই ভালো। কিন্তু গত দুই-তিন মাসে যে ব্যবসায়িক মন্দা যাচ্ছে সেটা শুধু বাংলাদেশকে ইফেক্ট করছে না, ভারতকেও ইফেক্ট করছে। পরিমাণটা অত কিন্তু বেশি নয়, তবে ইফেক্ট কিন্তু পড়ছে। কলকাতার অর্থনীতি, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে হলে আগে স্বীকার করতে হবে যে সমস্যা আছে। আমাদের এটিও স্বীকার করতে হবে যে ৫ আগস্টের আগে এবং পরে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের একটি গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। এটা মেনে নিয়ে আমাদের চেষ্টা করতে হবে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে। সে হিসেবে আমি প্রস্তাব করেছি, আমাদের যে ফরেন অ্যাফেয়ার্স কনসালটেশন আছে সেটি শুরু করব। বিশ্লেষকরা বলছেন, পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠক থেকে বড় কিছু অর্জনের সুযোগ না থাকলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দুই দেশ বৈঠক বা আলোচনায় বসেছে- এটাই হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এ সুযোগে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে ভারতের কাছে। ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্ক এখন থেকে হতে হবে সমতা, ন্যায্যতা-মর্যাদা ও পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে। বাংলাদেশের এ অবস্থানই বৈঠকে স্পষ্ট করবে সরকার। বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতা মেনে বিশেষ কোনো দল নয়, প্রতিবেশী দুই দেশের স্বাভাবিক টেকসই সম্পর্কের প্রত্যাশার কথা জানানো হবে। অপপ্রচার বন্ধ করতে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভব সব ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হবে। সেই সঙ্গে ঢাকার পক্ষ থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার অনুরোধও জানানো হবে। নয়াদিল্লির কূটনৈতিক সূত্রের খবর, ভারতের পক্ষ থেকে মূলত চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে স্বাভাবিক সম্পর্ক রক্ষায় ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বার্তা পৌঁছানো হবে। বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের বাংলাদেশবিরোধী প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারের যে কোনো প্রশ্রয় নেই এ বার্তা দেওয়া হবে বাংলাদেশকে। আলোচনায় ভিসা বিষয়টিও আসবে। আগের মতো স্বাভাবিক ট্যুরিস্ট ভিসার প্রক্রিয়া আলোচনায় না এলেও গত বছরের মাঝামাঝি শেষে হওয়া ভিসা অ্যাগ্রিমেন্ট পুনরায় নবায়ন করার বিষয়টি আলোচনা আসবে। কারণ এই অ্যাগ্রিমেন্ট শেষ হয়ে যাওয়ায় সরকারি কর্মকর্তা ও কূটনীতিক যাওয়া-আসাতেও এক ধরনের সংকট তৈরি হয়ে আছে। এরই মধ্যে দুই দেশের জয়েন্ট সেক্রেটারি পর্যায়ের কর্মকর্তাকে ফেরত পাঠানোর ঘটনাও ঘটেছে। এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানোর আলোচনা হবে। পাশাপাশি ভারতের লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বাংলাদেশে শুরু হওয়া প্রকল্পগুলো এখন প্রায় এক ধরনের স্থবির হয়ে আছে। এ প্রকল্পগুলো কীভাবে চালু করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হবে। অন্যান্য বারের মতো প্রকল্পগুলোর পুনর্মূল্যায়নও করা হবে। আগামী ২০২৬ সালে শেষ হতে যাওয়া গঙ্গা চুক্তি নবায়নের জন্য এখনই আলোচনা শুরু না করলে সময়মতো নবায়ন সম্ভব নাও হতে পারে। সেটি বিবেচনায় নিয়ে শিগগিরই যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক করা যায় কি না তা নিয়ে প্রস্তাব থাকতে পারে ভারতের পক্ষ থেকে। পাশাপাশি বাংলাদেশে থাকা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার বিষয়ে ভারতের আকাক্সক্ষা পুনরুল্লেখ করা হবে বলে সূত্রের খবর। সর্বশেষ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর প্রণয় ভার্মা সাংবাদিকদের বলেছেন, কোনো নির্দিষ্ট একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক মূল্যায়ন করা যাবে না।