১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণ অভ্যুত্থানের পর দেশে প্রথমবারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণ অভ্যুত্থানের মাত্র ৯০ দিনের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করেছিল। ওই নির্বাচন বিশ্বে প্রশংসিত হয়। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারও ৯০ দিনের মধ্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। অর্থাৎ এটি প্রমাণিত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যে কোনো পরিস্থিতিতে ৯০ দিন যথেষ্ট সময়। অনেকেই ২০০৭ সালের এক-এগারোর সরকারের উদাহরণ দিতে চাইবেন। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সেনাসমর্থিত ওই সরকার আমলে তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্র্বর্তী সরকার ছিল না। এটা ছিল একটি ‘ষড়যন্ত্রের সরকার’। বিদেশি বিশেষ করে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এ দেশের সুশীল গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের ফসল ছিল ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন আহমেদের ওই সরকার। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, বরং বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতি ধ্বংস করাই ছিল ওই সরকারের প্রধান এজেন্ডা। তাই ওই বিরাজনীতিকরণ ষড়যন্ত্রের নীলনকশার সরকারের সঙ্গে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তুলনা করা উচিত নয়। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকারের মেয়াদ ১০ মাস হতে চলল। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ সরকারের নেতৃত্বে। তিনি শান্তিতে নোবেলজয়ী। বিশ্ববরেণ্য একজন দক্ষ এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তিনি একজন ক্রাইসিস ম্যানেজার। জাতির অভিভাবক। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে তিনি জনগণের কাছে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। যেহেতু ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার আবর্জনা পরিষ্কার করেই একটি নির্বাচন আয়োজন করা দরকার। এজন্য সব রাজনৈতিক দল তাঁকে সময় দিয়েছে। কিন্তু যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। এখন নির্বাচন নিয়ে আর কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতার চরম মাশুল দিতে হবে গোটা জাতিকে।
‘সিদ্ধান্তহীনতা’ একটি ভয়ংকর ঘাতক ব্যাধি। একজন ব্যক্তি কিংবা একটি সরকার এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ব্যক্তি এ রোগে আক্রান্ত হলে তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। নানান সমস্যায় জড়িয়ে যান। হতাশা তাকে আক্রান্ত করে। আর একটি সরকার যদি ‘সিদ্ধান্তহীনতা’র অসুখে আক্রান্ত হয়, তাহলে তার মাশুল দিতে হয় গোটা জাতিকে। রাষ্ট্র হয় পথহারা। স্থবির, অচল হয়ে যায় রাজনীতি, অর্থনীতি। দেশে দেখা যায় অস্থিরতা। নয় মাসে দেশে ঠিক এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
সবাই আশা করেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এ সরকার দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করবে। এ দেশের জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেবে। বাংলাদেশকে একটি গণতন্ত্রের বন্দরে নিরাপদে নিয়ে যাবে। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে, তত মনে হচ্ছে অন্তর্র্বর্তী সরকার যেন পথ হারিয়েছে। পুরো বাংলাদেশ যেন একটা ঝুঁকির মুখে। এটার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়ী নন, বরং এ সরকারের ভিতর কিছু মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যারা আসলে সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত এবং বিভ্রান্ত করছে। তারা বিরাজনীতিকরণের নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। দেশ গণতন্ত্রহীন রাখতে চায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশ্বব্যাপী ইমেজ পুঁজি করে এরা এক-এগারোর এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে আদালতের রায় অনুযায়ী চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন ডা. শাহাদাত হোসেন। একইভাবে ঢাকায়ও ইশরাক হোসেন আদালতের শরণাপন্ন হলেন। ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে ঘোষণা করলেন আদালত। আদালতের এ রায় ঘোষণার পর গেজেট প্রকাশিত হলো, কিন্তু গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পরেও এখন পর্যন্ত তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হচ্ছে না। এ নিয়ে ঢাকা শহরে চলছে হুলুস্থুল। কেন এ সিদ্ধান্তহীনতা?
মাস দুই-এক আগে তিতুমীরসহ সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলেন। বিশেষ করে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন বেশ বড় আকার ধারণ করল। তিন দিন আন্দোলন চলার পর সরকারের টনক নড়ল এবং সরকার ঘোষণা করল সাতটি কলেজ নিয়ে একটি পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় করা হবে। সরকারের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন থেকে সরে গেলেন শিক্ষার্থীরা। এখন তারা নতুন করে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন। নতুন করে তারা কর্মসূচি দিচ্ছেন। কারণ যে ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন হয়নি। কেন, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই সরকারের কাছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কাকরাইলে তিন দিন ধরে লাগাতার অবস্থান করলেন। সড়ক বন্ধ করলেন, আন্দোলন করলেন। অবশেষে সরকারের টনক নড়ল এবং সরকার শেষ পর্যন্ত দাবিগুলো মেনে নিল। সময়ের সিদ্ধান্ত সময়ে না নিলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয়। এ সহজ বাস্তবতা সরকার বুঝতে পারছে না কেন? এ রকম উদাহরণ অনেক। আমরা দেখছি প্রধান উপদেষ্টা যা বলছেন সরকারের কোনো কোনো মহল তা বাস্তবায়নে যেন গড়িমসি করছে। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাম্য হত্যার কথাই ধরা যাক। চার দিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অচল। রবিবার ছাত্রদলের ছেলেরা সাম্য হত্যার বিচার দাবিতে শাহবাগ অবরোধ করে রেখেছিলেন। প্রশ্ন উঠছে-সাম্য হত্যার বিচার কে না চায়? সরকার নিশ্চয়ই চায়। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অসুবিধা কোথায়?
শেয়ারবাজার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করলেন। এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দিলেন। এ নির্দেশনার পর হিতে বিপরীত ফল হলো। শেয়ারবাজারের অবস্থা এখন তলানিতে। শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি আতঙ্কজনক। সেখানে বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় আছেন।
গত নয় মাসে ১২ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। আসামি লক্ষাধিক। সরকার নিজেরাই বলছে মামলাগুলো ভুয়া। আবার এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। মাসের পর মাস তদন্তহীন অবস্থায় ঝুলে আছে মামলা। আবার অনেকের মামলা প্রত্যাহার হয়েছে রকেট গতিতে। একটি হত্যা মামলা মাত্র ১০ দিনে কোনো শুনানি ছাড়া নিষ্পত্তি হয়েছে। সব যেন ম্যাজিক। এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন গোটা দেশ। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এ সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁদের কেউ কেউ কি ইচ্ছা করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য চেষ্টা করছেন? এ সরকারের ভিতর বা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু ব্যক্তি আছেন, যাঁরা এক-এগারোর কুশীলব ছিলেন। এক-এগারোর সময় তাঁদের বিরাজনীতিকরণ এবং রাজনীতিবিদদের চরিত্রহননের ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল। দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের নীলনকশা বাস্তবায়নেও তাঁরা সক্রিয় ছিলেন। সেই শক্তি আবার বর্তমান সরকারের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। তাঁরা এমন সব কর্মকা করছেন যাতে সরকার বিতর্কিত হচ্ছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের প্রধান হলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি, ঐকমত্য কমিশনের কিছু কিছু ব্যক্তি যেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে কোনো মূল্যে বিরোধ উসকে দিতে চাইছেন। এটি কোনো শুভলক্ষণ হতে পারে না। ঐকমত্য কমিশনের এ কালক্ষেপণও বিভিন্ন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। জুলাই গণহত্যার বিচার, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, জুলাই বিপ্লবের শহীদদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন, নির্বাচন কমিশন, সংবিধান সংস্কার বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত। তাহলে নির্বাচন করতে বিলম্ব কেন? এখন দেশের যে পরিস্থিতি তা অন্তর্র্বর্তী সরকার সামাল দিতে পারছে না। পারবেও না। প্রতিদিন দাবির স্তূপ। সড়ক অবরোধ, বিশৃঙ্খলা। কোথাও কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। শিক্ষাঙ্গনে লেখাপড়া হচ্ছে না। সরকারি অফিসে আতঙ্কে সবাই চুপচাপ বসে আছেন। কোনো কাজ হচ্ছে না, অর্থনীতি স্থবির। কোনো সুখবর নেই। অনেক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সরকারের মধ্যে স্বচ্ছতার অভাব দেখা দিচ্ছে। যেমন নির্বাচন নিয়ে সরকারের কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান নেই, বরং সরকারের ভিতরে থাকা ঐকমত্য কমিশনের নামে সরকার নির্বাচন নিয়ে নানারকম বক্তব্য দিচ্ছে, যেটি সরকারের বক্তব্যের স্ববিরোধী। আবার দেখা যাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন নীতি এবং কর্মকাে র মধ্যেও এক ধরনের স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। বিশেষ করে মিয়ানমারকে করিডর দেওয়া হবে কি না কিংবা চট্টগ্রাম বন্দর কার কাছে দেওয়া হবে, এসব নিয়ে নানারকম অস্বস্তিকর, স্ববিরোধিতা লক্ষ করা যাচ্ছে; যা জনগণের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করছে। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। অন্তর্র্বর্তী সরকারের এখন কাজ একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং তা যত দ্রুত সম্ভব। সরকার চাইলে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে পারে। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে পারে। নির্বাচন নিয়ে যত কালক্ষেপণ হবে ততই এ সরকার বিতর্কিত হবে। সমালোচিত হবে।
আমরা দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী অভিভাবক হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিকে অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান করেছি। সবার শ্রদ্ধাভাজন এ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বকে যেন বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্র করছে সরকারের ভিতর একটি গোষ্ঠী। আমাদের সমাজে সর্বজনগ্রহণযোগ্য বিতর্কের ঊর্ধ্বে মানুষের সংখ্যা খুবই কম। এ মানুষটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না। দ্রুত নির্বাচন দিয়ে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে তুলে দিন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, লতিফুর রহমান যদি ৯০ দিনে নির্বাচন করতে পারেন, তাহলে ড. ইউনূস কেন পারবেন না?
লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক
Email : [email protected]