‘সরকার একদিকে প্রণোদনাসহায়তা হ্রাস করছে, অন্যদিকে জ্বালানিসহ অন্যান্য সেবার মূল্য বৃদ্ধি করছে। ফলে বেসরকারি খাত ক্রমাগত প্রতিকূল অবস্থায় পড়ছে, যা মোটেই কাম্য নয়। এলডিসি-পরবর্তী সময়ে জিএসপি সুবিধা চলে গেলে আমাদের তৈরি পোশাকপণ্যের মূল্য ৯.৫% বৃদ্ধি পাবে। পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কারোপ, রপ্তানির ওপর ভারতের নিষেধাজ্ঞা, রিজার্ভস্বল্পতা ও আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা এবং আইনশৃঙ্খলার অস্থিরতার কারণে শিল্প খাতে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা ব্যাহত হচ্ছে।’ গতকাল ‘বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি নীতিমালা : এলডিসি-পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয়তা এবং চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সেমিনারে ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন। রাজধানীর মতিঝিলে নিজস্ব অডিটোরিয়ামে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য (কাস্টমস) কাজী মোস্তাফিজুর রহমান এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন।
স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, চামড়া, ওষুধ, পাটপণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রভৃতি পণ্যগুলোর রপ্তানির সম্ভাবনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। অন্যদিকে মোট রপ্তানি ৮৪% তৈরি পোশাক ও সুনির্দিষ্ট কিছু বাজারের ওপর নির্ভরশীল। শিল্প খাতের মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিনির্ভর আমাদের অর্থনীতিতে দীর্ঘদিনের উচ্চ মূল্যস্ফীতি, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পারস্পরিক শুল্কারোপ, রপ্তানির ওপর ভারতের নিষেধাজ্ঞা, রিজার্ভস্বল্পতা ও আইনশৃঙ্খলার অস্থিরতার কারণে শিল্পের উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। মূল প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে শুল্ক ও শুল্কের হার বেশি। এ ছাড়া আমরা এখনো আমদানি করের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। রাজস্ব খাতে সংস্কারের অভাব এবং প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে কর বৃদ্ধিতে সরকারের ব্যর্থতার ফলে পরোক্ষ কর ও আমদানি করের ওপর ব্যাপক নির্ভরতা দেখা দিচ্ছে।
বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত ধ্বংস হয়ে যাবে, এ আশঙ্কা নেই। তবে আমাদের এ খাতে উচ্চমানের পণ্যের উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। তিনি বলেন, সরকার একদিকে প্রণোদনাসহায়তা হ্রাস করছে। অন্যদিকে জ্বালানিসহ অন্যান্য সেবার মূল্য বৃদ্ধি করছে। ফলে বেসরকারি খাত ক্রমাগত প্রতিকূল অবস্থায় পড়ছে, যা মোটেই কাম্য নয়।
মো. মসিউল ইসলাম বলেন, এলডিসি-পরবর্তী সময়ে আমরা ৪৩টি পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হব। তাই এলডিসি-পরবর্তী সময়ে শিল্প খাতে নগদ সহায়তা কীভাবে বিকল্প পন্থায় প্রদান করা যায়, সে বিষয়ে নীতিকৌশল প্রণয়ন করতে হবে। তৈরি পোশাক উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের এখন কমপক্ষে ৭০% ম্যান-মেড ফাইবার ব্যবহারের দিকে এগোতে হবে। কেননা বিশ্ববাজারে এর চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। তাই এখানে পিছিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই চলবে না।
সৈয়দ আলমাস কবীর আমাদের রপ্তানি পণ্যের বিদ্যমান বাজারে নতুন নতুন পণ্য রপ্তানি সম্প্রসারণ, মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে সম্ভাবনাময় পাঁচটি দেশে বিপণন অফিস স্থাপনের প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি এখন পণ্যের এক্সটেনশন বা বর্ধিতকরণও করার সময় এসেছে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের আওতায় এ ধরনের গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে প্রণোদনা প্রদানে তিনি আহ্বান জানান।
ডেল্টা ফার্মা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মো. জাকির হোসেন বলেন, এলডিসি উত্তরণের পরও যেন বাংলাদেশ ট্রিপসের সুবিধাটি কমপক্ষে আরও ছয় বছর পেতে পারে তার জন্য কার্যকর নেগোসিয়েশন প্রয়োজন। এ ছাড়া বেশকিছু পণ্য এ সময়ের মধ্যেই রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিতে পারলে তা পরবর্তীতে আর পেটেন্টের আওতায় আনতে হবে না এবং দেশি বাজারে ওষুধের দামও নাগালের মধ্যে থাকবে। তিনি সরকারকে এ খাতে নতুন নতুন উদ্ভাবন নিয়ে আসতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব করেন, যা প্রযুক্তি আদানপ্রদানে সহায়তা করবে।
ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ বলেন, এলডিসি-পরবর্তী সময়ে জিএসপি সুবিধা চলে গেলে আমাদের তৈরি পোশাকপণ্যের মূল্য ৯.৫% বাড়বে। ফলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। এ ছাড়া বন্দর ব্যবস্থাপনার অটোমেশনের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানিতে লিড টাইম হ্রাসের ওপর তিনি জোর দেন।