অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন হবে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন। ১৭ বছর পর একটা প্রকৃত নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সময়টা (২০২৬ সালের এপ্রিল) ঠিক আছে। জনগণও ভোটের জন্য প্রস্তুত। প্রথমবার ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে দেশের তরুণ ভোটাররা। আগামী মাসে জাতির সামনে জুলাই চার্টার উপস্থাপন করা হবে। এর ভিত্তিতে হবে নির্বাচন। গতকাল লন্ডনের প্রভাবশালী নীতি গবেষণা সংস্থা চ্যাথাম হাউসে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স আয়োজিত নীতি সংলাপে অংশ নিয়ে তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন চ্যাথাম হাউসের পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ব্রনওয়েন ম্যাডক্স।
সঞ্চালকের প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, নির্বাচন নিয়ে পুরো দেশে একটা উত্তেজনা কাজ করছে। সব তরুণ জনগোষ্ঠী, যারা কখনো তাদের প্রথম ভোট দিতে পারেনি। তাদের মধ্যে উত্তেজনা কাজ করছে। এটা নিয়ম রক্ষার ভোট নয়। নতুন দেশ গড়ার জন্য ভোট। তরুণরা যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রক্ত দিয়েছে, তাদের সে স্বপ্ন পূরণের দায় নিয়েছি আমরা। আমরা তাদের স্বপ্নকে সম্মান করি। আমরা পুরোনো বাংলাদেশকে বিদায় দিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই। নতুন বাংলাদেশ তিনটা বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য আমরা অনেকগুলো কমিশন করে দিয়েছি। তারা অনেক সুপারিশ জমা দিয়েছেন। আমরা সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করার চেষ্টা করছি। সব দল যে সুপারিশগুলোয় একমত হবে, সেগুলো নিয়ে একটা জাতীয় দলিল হবে, যেটাকে আমরা জুলাই চার্টার (সনদ) বলছি। সেখানে সব দল স্বাক্ষর করবে। আগামী মাসে জুলাই চার্টার জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে। এর ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দ্বিতীয় এজেন্ডা হলো গত জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে গণহত্যা ঘটেছে তার বিচার নিশ্চিত করা। তৃতীয় এজেন্ডা হলো নির্বাচন। এ তিন দায়িত্ব বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মতো বড় দল আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় অনেকে নির্বাচন ‘ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার’ হবে না বলে মনে করছেন-সঞ্চালকের এমন কথার জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে। মানুষ গুম করেছে। দেশের অর্থ চুরি করেছে। তবু তাদের আমরা রাজনৈতিক দল বলছি। ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেলে সারা দেশের মানুষ উৎসব করেছে। পালানোর পরও বিদেশের মাটিতে বসে তারা নানান অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, রাস্তায় মারামারি করছে। দেশ, দেশের মানুষ ও রাজনীতির নিরাপত্তার স্বার্থে জাতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এসবের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম বন্ধ থাকা দরকার। আমরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করিনি। সাময়িকভাবে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের লুটপাটের প্রসঙ্গ তুলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তারা অর্থনীতি ধ্বংস করে রেখে গেছে। অসংখ্য বিল বকেয়া রেখে গেছে। ব্যাংকিং সিস্টেম ধ্বংস করে দিয়েছে। শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে তারা ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুটপাট করেছে। আমরা শুধু শূন্য নয়, একেবারের নেতিবাচক অবস্থা থেকে যাত্রা করেছি। ব্যাংকিং সিস্টেম ঠিক করতে হচ্ছে। বিপুল বকেয়া পরিশোধ করতে হচ্ছে। রেমিট্যান্স পাঠিয়ে এ বিপদের মুখ থেকে দেশকে রক্ষা করছেন প্রবাসীরা।
সংলাপে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আগে পাসপোর্টসহ বিভিন্ন সরকারি সেবা পেতে ‘মাধ্যম’ প্রয়োজন হতো। যার মধ্য দিয়ে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হতো। এখন সরকারি বিভিন্ন সেবা অনলাইনের মাধ্যমে প্রদান করা হচ্ছে, যাতে সবাই সহজেই সেবা নিতে পারছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ড. ইউনূস বলেন, সাত বছর আগে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা পাঁচ মাস থেকে শুরু করে পাঁচ বা সাত বছর বয়সি ছিল, তারা সবাই এখন যুবক বা কিশোর। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিভিন্ন কর্মসূচিতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়ায় এখন তাদের ভরণপোষণ খরচ কারা দেবে? তাদের তো থাকার নির্দিষ্ট সময়ও নেই। বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্বসহকারে কাজ করছে।
নির্বাচিত সরকারের অংশ হওয়ার কোনো ইচ্ছা আছে কি না-এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে দুই হাত নেড়ে হাস্যোজ্জ্বল ড. ইউনূস বলেন, নো ওয়ে, নো ওয়ে (একদমই না)। আমার মনে হয় আমাদের উপদেষ্টা পরিষদের কোনো সদস্যই এমনটা করবেন না। আমাদের দায়িত্ব হলো ট্রানজিশনটা (গণতান্ত্রিক রূপান্তর) ভালোভাবে সম্পন্ন করা এবং জনগণকে খুশি করা। নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। আমরা সেটাই করতে চাই। এটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি নির্বাচন ভুল হয়, তাহলে এ বিষয়টার আর সমাধান হবে না।
শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, তিনি শুধু সেখানে থাকছেন না, অপপ্রচার চালাচ্ছেন। আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি। তিনি (নরেন্দ্র মোদি) বলেছেন, সমাজমাধ্যমে অপপ্রচার চালালে এর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। এ সময় ভারতের গণমাধ্যম থেকেও একের পর এক গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যুক্তরাজ্যের সহায়তা কামনা : যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জোনাথন পাওয়েল গতকাল সকালে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তাঁর হোটেলে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে রোহিঙ্গাসংকট সমাধানে যুক্তরাজ্যের সক্রিয় ভূমিকা কামনা করেন অধ্যাপক ইউনূস। বৈঠকে পাচার হওয়া বাংলাদেশি সম্পদ উদ্ধার, সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি, দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া, দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশের চলমান গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিয়েও আলোচনা হয়। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাজ্য সরকারের সহযোগিতার মনোভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ড. ইউনূস বলেন, পূর্ববর্তী সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়েছে। এটা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। তিনি রোহিঙ্গাসংকট মোকাবিলায় আসন্ন জাতিসংঘ সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের সক্রিয় সমর্থন কামনা করেন এবং ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসনে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা বাড়ানোর আহ্বান জানান।
জোনাথন পাওয়েল বাংলাদেশের এ সংকটকালে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য অব্যাহত সমর্থন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন।