ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমানার শুনানি নিয়ে গতকাল দিনভর নির্বাচন কমিশনের সামনে মিছিল-বিক্ষোভ করেছেন বিভিন্ন জেলার বাসিন্দারা। আজ শুনানির শেষ দিন। শুনানিতে মানিকগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের চারটি আসন পুনর্বহালের দাবি উঠেছে। নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের পুরোনো সীমানা ফিরে পেতে চায় এলাকাবাসী। তুরাগকে অন্য আসনের সঙ্গে যুক্ত না করার দাবি উঠেছে। দোহার-নবাবগঞ্জ পুনর্বিন্যাস চায় না এলাকাবাসী। এদিকে কামরাঙ্গীরচর থানা ছাড়া ঢাকা-২ আসন নয়; এ ক্ষেত্রে এ থানার অন্তর্গত ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড তিনটি ঢাকা-২ আসনের সঙ্গেই রাখার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী। গতকাল শুনানিতে অংশ নিয়ে এসব দাবি জানানো হয়। এদিকে একটি আসন বাড়ানোয় গাজীপুরবাসী অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনকে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে কোনো ধরনের সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন গাজীপুরের বিএনপি নেতারা। গতকাল আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে ঢাকা অঞ্চলের শুনানি শুরু হয় সকালে, চলে বিকাল পর্যন্ত। গতকাল ৬টি জেলার ২৮টি সংসদীয় আসনের শুনানি হয়। এতে গাজীপুরের প্রতিনিধিরা দাবি-আপত্তির শুনানিতে এসে ছোটখাটো অভিযোগ করলেও মূলত তারা প্রশংসায় ভাসিয়েছেন নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনসহ চার নির্বাচন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। শুনানির সঞ্চালনায় ছিলেন ইসি সচিব আখতার আহমেদ।
গত ৩০ জুলাই ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে খসড়া প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। এতে ভোটার সংখ্যার সমতা আনতে গিয়ে বাগেরহাটের আসন চারটি থেকে কমিয়ে তিনটির প্রস্তাব করা হয়। আর গাজীপুর জেলায় একটি আসন বাড়িয়ে করা হয় ছয়টি। বাগেরহাটবাসী আসন কমানোর ইসির কঠোর সমালোচনা করলেও উল্টোচিত্র গাজীপুরবাসীর।
শুনানি থেকে বেরিয়ে গাজীপুর মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম মঞ্জুরুল করিম রনি বলেন, আমাদের কয়েকজন শুনানিতে বিভিন্ন আসনে থানা, ওয়ার্ড সংযোজনের দাবি দাবি জানিয়েছেন। বাকি সবাই ইসির পক্ষে ছিলাম। আসন বাড়ানোয় আমরা কমিশনকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক বিএনপি নেতা এ কে এম ফজলুল হক মিলন বলেন, এবার গাজীপুরে ৫টি থেকে ৬টি আসন করেছে; সেজন্য ইসির প্রতি তাদের অভিনন্দন, কৃতজ্ঞতা আছে। আমাদের ছোটখাটো কিছু দাবি ছিল, অত্যন্ত শালীনতার সঙ্গে তা তুলে ধরা হয়েছে। দু-একটি বিষয়ে ইসি যে সিদ্ধান্ত দেবেন তা আমরা মেনে নেব।
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে পুরোনো সীমানা চায় এলাকাবাসী : দুপুরের আগে নারায়ণগঞ্জ-৩, ৪, ৫ আসনের আপত্তি আবেদনেরও শুনানি হয়। শুনানি শেষে নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি মাকসুদুল খন্দকার খোরশেদ সাংবাদিকদের বলেন, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে পাঁচটি ইউনিয়নকে কেটে সোনারগাঁও (নারায়ণগঞ্জ-৩) আসনের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের মানুষ রাজনৈতিক, সামাজিক ও ভৌগোলিকভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছে। সীমানার কারণে আগামী ‘নির্বাচনও আটকে যেতে’ পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। আশা করি, অবশ্যই নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আমাদের দাবি পুনর্বিবেচনা করবে। নতুবা আমরা মনে করি আগামী যে নির্বাচন এ জনগণের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনকে বানচাল করার লক্ষ্যে এ ধরনের উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে। যেখানে আমরা মনে করি এগুলো হাই কোর্ট সুপ্রিম কোর্ট করলে নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে। পূর্ব নির্ধারিত যে সীমানা ছিল সেই সীমানায় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন সাবেক যুবদল নেতা। কামরাঙ্গীরচর থানা ছাড়া ঢাকা-২ আসন নয়। এ ক্ষেত্রে এ থানার অন্তর্গত ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড তিনটি ঢাকা-২ আসনের সঙ্গেই রাখার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী। নির্বাচন ভবনে সংসদীয় আসনের শুনানি শেষে এমন দাবি জানান তারা।
অ্যাডভোকেট নুরে আলম সিদ্দিকী সোহাগ বলেন, ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডকে ঢাকা-২ আসন থেকে পৃথক করেছে কমিশন। সেখানে ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডকে ঢাকা-১০ আসনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডকে তারা ঢাকা-৭ আসনের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ইসি এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ৫৯টি আবেদন পড়েছে। ৫৯টি আবেদনের মধ্যে ৫৭টি আবেদন হচ্ছে বিপক্ষে আর দুটি আবেদন পক্ষে। তিনি আরও বলেন, আমরা বলেছি যে, ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড কামরাঙ্গীরচরের অধীনে যেটা আছে, এ তিনটি ওয়ার্ড ঢাকা-২ আসনের মধ্যেই থাকবে। কেন থাকবে, কারণ ঢাকা-২ আসনে একটি মাত্র থানা কামরাঙ্গীরচর। আর বাকি হলো কেরানীগঞ্জ ও সাভার উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন। কামরাঙ্গীরচর থানা নিয়েই ঢাকা-২ আসন।
তুরাগকে অন্য আসনের সঙ্গে যুক্ত না করার দাবি উঠেছে। দোহার-নবাবগঞ্জেও পুনর্বিন্যাস চায় না এলাকাবাসী। এ ছাড়া ঢাকা-৭ আসনের সঙ্গে ৫৫ নম্বর ওয়ার্ড যুক্ত করার দাবি উঠেছে। গতকাল স্ব স্ব আসনের এলাকাবাসী নির্বাচন ভবনে এসব দাবি নিয়ে মানববন্ধন করেন। তুরাগকে সংসদীয় আসন ঢাকা-১৮ থেকে ঢাকা-১৬ সংযুক্ত করা চলবে না। এমন দাবি জানিয়েছেন তুরাগের জনগণ।
এদিকে কামরাঙ্গীরচরের জনগণের ব্যানারে একদল এলাকাবাসী ঢাকার দক্ষিণ সিটির ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডকে ঢাকা-৭ আসনের সঙ্গে যুক্ত করায় ইসিকে অভিনন্দন জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডকেও ঢাকা-৭ আসনের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। এ ছাড়া দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলা সর্বস্তরের জনগণের ব্যানারে একদল এলাকাবাসী ঢাকা-১ আসনকে পুনর্বিন্যাস না করার দাবি জানিয়েছে। আবার ঢাকা-১ আসন (দোহার ও নবাবগঞ্জ) আগের মতো পৃথক দুটি আসন করার দাবি এসেছে ইসির কাছে।
মানিকগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের চার আসন পুনর্বহালের দাবি : মানিকগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের চারটি আসন পুনর্বহালের দাবি উঠেছে। নির্বাচন ভবনে সংসদীয় আসনের শুনানিতে জেলা দুটির প্রতিনিধিরা এ দাবি জানিয়েছেন। মানিকগঞ্জের প্রতিনিধি ব্যারিস্টার খাইরুল আলম চৌধুরী বলেন, ২০০১ সাল পর্যন্ত মানিকগঞ্জ জেলায় চারটি সংসদীয় আসন ছিল। ২০০৮ সালে মানিকগঞ্জে একটি আসন কমিয়ে তিনটি করা হয়। এতে করে সংসদে মানিকগঞ্জের জনগণের প্রতিনিধিত্ব কমেছে। চারটি আসন থাকায় মানিকগঞ্জে যে বরাদ্দ ছিল তা কমে গেছে। আমরা চারটি আসনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছি।
গত ২৪ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই শুনানি চলবে আজ ২৭ আগস্ট পর্যন্ত; এ চার দিনের দাবি-আবেদন নিষ্পত্তি করে চূড়ান্ত সীমানা প্রকাশ করবে ইসি। আজ রংপুরের সাতটি, রাজশাহীর ২৩২টি, ময়মনসিংহের তিনটি, ফরিদপুরে ১৮টি ও সিলেট অঞ্চলের দুটি দাবি-আপত্তির শুনানি হবে। শুনানি শেষে চূড়ান্ত সীমানা প্রকাশ করবে ইসি।
বিএনপি-এনসিপির মারামারি নিয়ে জিডি ইসির : ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩ আসনের খসড়া সীমানা নির্ধারণের শুনানিতে বিএনপি ও এনসিপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে মারামারির ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল ঢাকার শেরেবাংলা থানায় এ জিডি করা হয় জানিয়ে ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, জিডিতে আমরা কারও নাম উল্লেখ করিনি। শুনানিতে হাতাহাতি হয়েছে; আমরা পুলিশকে জানিয়েছি। তদন্তের বিষয়টি পুলিশের ব্যাপার।
জানা যায়, গত রবিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩ আসনের খসড়া সীমানার ওপর দাবি-আপত্তিতে শুনানি শুরু করে ইসি। শুনানির একপর্যায়ে দুই পক্ষ উত্তেজিত হয়ে মারামারি শুরু করে। তারপর ইসি কর্মকর্তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।