জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে গতকাল রাতে ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সফরসঙ্গী হয়েছেন তিন দলের চার নেতা, যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুক্ত হবেন দুজন। প্রায় দুই সপ্তাহের যুক্তরাষ্ট্র সফরসঙ্গীরা হলেন- বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুক্ত হবেন তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবীর ও যুক্তরাষ্ট্র জামায়াতের মুখপাত্র ড. নাকিবুর রহমান। প্রধান উপদেষ্টা ২৬ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেবেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বৈশ্বিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
এদিকে সরকার প্রধানের এ সফরে রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের যুক্ত করা নিয়ে চলছে নানান আলোচনা। কেউ বলছেন দেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে আবার কেউ বলছেন রাজনৈতিক ঐক্যের জায়গা স্পষ্ট করতেই হয়তো এমন সিদ্ধান্ত। প্রায় ৪৫ বছর পর কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে জাতিসংঘ সফরে যাচ্ছেন ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনীতিকরা। যা ঘিরে তৈরি হয়েছে কৌতূহল, প্রশ্ন। নেতাদের অনেকের ভাষ্য, বিরল এই সফরের উদ্দেশ্য নিয়ে রয়েছে নানা রহস্য। যাদের হাত ধরে আগামী বছর গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা শুরু হবে বাংলাদেশে, তাদের বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করতেই প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের বহরে সফরসঙ্গী করা হয়েছে।
রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সফরের নেপথ্যে রহস্য রয়েছে, যাকে কেন্দ্র করে তিন দলের প্রভাবশালী চার নেতা যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা, মিয়ানমারের সঙ্গে করিডর প্রসঙ্গসহ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব ও ভূরাজনীতি নিয়ে নানা কৌশল সম্পর্কে দেশের তিন দলের নেতাদের একটি অবস্থানে আনার চেষ্টার অংশ হতে পারে এই যাত্রা। কেউ কেউ বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন দলের ছয় রাজনীতিকের সফরসঙ্গী হওয়ার পেছনে কোনো পরাশক্তির ইঙ্গিতও থাকতে পারে। বিএনপির বাইরে বাকি দুটি দল কোন ক্রাইটেরিয়ায় ঠিক করা হয়েছে, এর পেছনে কারণ কী, তা কেবল উদ্যোক্তারাই বলতে পারবেন। তারা আরও বলছেন, দেশের ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কার ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় গত ছয় মাসে দফায় দফায় বৈঠক করেছে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যেখানে অন্তত ৩০টি দলের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। সংস্কার কমিশনগুলোর দেওয়া প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সংস্কার প্রশ্নে অনেক বিষয়ে একমত হলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো একমত হতে পারেনি দলগুলো। এমনকি, এসব আলোচনার মধ্যেই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন বা পিআরের দাবিতে মাঠের কর্মসূচিও শুরু করেছে জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি রাজনৈতিক দল, যার বিপরীত অবস্থান নিয়ে নানা মন্তব্য করছে বিএনপি। এমন প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে কেন কেবল এই তিনটি দলকেই বেছে নিল সরকার?
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জাতিসংঘে সফরসঙ্গী বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সফর প্রসঙ্গে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি নিরপেক্ষতা দেখানোর চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি সেখানে তিনি এই রাজনীতি দেখাতে চান যে, ‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে কাজটি করছি’। এ ছাড়াও দুটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। প্রবাসীদের সঙ্গে মিটিং আছে, তিনি সম্ভবত সেখানে চাচ্ছেন আমাদের। সফর শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের প্রথম দিকে দেশে ফিরবেন বলেও জানান মির্জা ফখরুল।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের গণমাধ্যমকে বলেছেন, সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের পাশাপাশি কিছু সেশন আছে যেখানে আমাদের পার্টিসিপেশন আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ কমিউনিটির সঙ্গেও একটা মিটিং রয়েছে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘যদি ধরে নেই, বড় দল হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতকে সঙ্গে নিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু এনসিপিকে কীভাবে যুক্ত করলেন? তিনি যদি মনে করতেন, সিনিয়র রাজনীতিকদের নেবেন বা প্রধান দলগুলো থেকে নেতা নেবেন, সেটা হতে পারত। আমি এই প্রশ্ন তুলতে চাই না, কারণ এতে মনে হবে আমি যেতে চাই। কিন্তু প্রশ্নটা থেকে যায়।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক জানান, আমি মনে করি, রহস্যটা হলো এদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন, সেখানে মার্কিন প্রভাবসহ এক ধরনের বোঝাপড়া তৈরি করা যায় কি না, এ বিষয়টি সম্ভবত কাজ করছে। সাম্প্রতিক কিছু বিষয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে বলেও আমি সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছি, তাদের এসব স্পষ্ট করা দরকার।
একটি দলের প্রধানের মন্তব্য, গত জুনে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর অনেকে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। সে কারণে জামায়াত-এনসিপিকে এবার যুক্ত করা হয়েছে জাতিসংঘ সফরে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার কোনো বিষয় থাকতে পারে। তিন দলকে বুঝিয়ে যদি নির্বাচনের দিকে একমত করতে পারেন, অসুবিধা কী।
রাজনৈতিক নেতাদের এই সফরে যুক্ত করার কারণ নিয়ে ধারণা দিয়েছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেছিলেন, যেহেতু আমরা একটি রূপান্তর পর্যায়ের দিকে এগোচ্ছি এবং দেশ পরিচালনার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের হাতে হস্তান্তর করা হবে, তাই তাদের প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জাতিসংঘের অধিবেশন তিন মাস ধরে চলে, হয়তোবা সরকার ভেবে দেখবে পরে আবার নতুন কাউকে পাঠাতে হয় কি না।
প্রসঙ্গত, গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাইডলাইনে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ বছরে সাইডলাইনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক হবে কি না, তা জানা যায়নি।