জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন নিউইয়র্কে। সারা দেশের মানুষের চোখ এখন নিউইয়র্কে। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ২৬ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা কী ভাষণ দেবেন তা নিয়ে নয়, নির্বাচন নিয়ে চলমান অনিশ্চয়তা এবং সংকটের সমাধান নিউইয়র্কে হবে কি না সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বাংলাদেশে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে নাকি দেশ বিভক্তির রাজনীতির চোরাবালিতে আটকে যাবে?- এই প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে আগামী দুই সপ্তাহে নিউইয়র্কে। গত জুনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডনের বৈঠক নির্বাচনের কলি জন্ম দেয়। ওই বৈঠকে প্রথম ড. ইউনূস সরকার আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। সেই ঘোষণা কি নিউইয়র্কে পূর্ণতা পাবে?
ড. ইউনূসের এবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান অন্যবারের তুলনায় ভিন্ন। এবার সফরসঙ্গী হয়েছেন তিন দলের ছয় নেতা, এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুক্ত হয়েছেন দুজন। প্রায় দুই সপ্তাহের এই সফরে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীরা হলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুক্ত হয়েছেন তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবীর ও যুক্তরাষ্ট্র জামায়াতের মুখপাত্র ড. নাকিবুর রহমান। এই সফরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান ড. ইউনূস কীভাবে তুলে ধরবেন, তা নিয়ে যত না আগ্রহ তৈরি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট এবং অচলাবস্থার অবসানের সম্ভাবনা নিয়ে। তিন দলের ছয় নেতার সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার এ সফর হতে পারে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের প্ল্যাটফর্ম।
আমরা গত ১৩ মাসে দেখেছি, যখনই দেশ একটি রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে তখনই ড. ইউনূস সেই সংকট উত্তরণের অভিনব উপায় খুঁজে বের করেছেন। দেশের মানুষের উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে স্বস্তি দিয়েছেন। তাই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন দলের ছয় নেতার সফরের দিকে তাকিয়ে আছে গোটা দেশ। এ সফরকে অনেকে গত জুনে প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের সঙ্গে তুলনা করছেন।
গত জুনের কথা মনে আছে? নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং গুমোট এক পরিস্থিতির মধ্যে পালিত হয়েছিল পবিত্র ঈদুল আজহা। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করেছিল। এরকম একটি অস্বস্তির মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গেলেন যুক্তরাজ্যে। ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঐতিহাসিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। যৌথ বিবৃতিতে বলা হলো, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মুহূর্তে কেটে গেল অবিশ্বাস আর অনিশ্চয়তা। একটা স্বস্তির পরিবেশ তৈরি হলো জনগণের মধ্যে।
ঠিক তিন মাস পর আবার এমনই এক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। গত ৫ আগস্ট জুলাই বিপ্লবের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন সমঝোতার আলোকে আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা কিছু রাজনৈতিক দলের পছন্দ না হলেও সাধারণ মানুষ এটিকে স্বাগত জানায়। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মনে যাই থাকুক, সবাই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ঘোষণা মেনে নিয়েছে।
কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি না থাকলেও বিপত্তি ঘটে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে একটি খসড়া জুলাই সনদ তৈরি করেছে। এটি মূলত রাষ্ট্র সংস্কার দলিল। আগামীতে বাংলাদেশ কীভাবে পরিচালিত হবে তার নির্দেশনা রয়েছে এই দলিলে। বাংলাদেশ যেন একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহির গণতন্ত্রের পথে পরিচালিত হয় সেজন্যই এই রাষ্ট্র সংস্কার পরিকল্পনা। এই রাষ্ট্র সংস্কারের প্রধান লক্ষ্য হলো, এ দেশে আর কোনো ফ্যাসিবাদ যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। জুলাই সনদের বিষয়বস্তু নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। দীর্ঘ আট মাসের বেশি সময় ধরে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই সনদ চূড়ান্ত হয়েছে। সব রাজনৈতিক দলই জুলাই সনদ তৈরিতে ছাড় দিয়েছে। সবাই মিলে আগামীর বাংলাদেশ কোন পথে এগোবে তার রূপকল্প তৈরি করেছে। কিন্তু বিপত্তি হচ্ছে, এই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে। তা ছাড়া জামায়াত আগামী নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি চালু করার দাবি তুলেছে। খালি চোখে, অনেকে চলমান সংকটের সমাধান অত্যন্ত কঠিন এবং প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তাদের বিরোধ মনস্তাত্ত্বিক। পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার অভাবের কারণেই এ বিভক্তি। জুলাই সনদে কিছু মৌলিক সাংবিধানিক পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। সংবিধান পরিবর্তনের একমাত্র এখতিয়ার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। সংসদ ছাড়া এখন যদি সাংবিধানিক আদেশে কিংবা গণভোটে জুলাই সনদ গৃহীত হয় তাহলে ভবিষ্যতে তা আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বৈধ কর্তৃপক্ষ ছাড়া এভাবে আইনই বদল করা যায় না, আর সংবিধান তো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। আমরা যদি সত্যিই নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই তাহলে আমাদের অবশ্যই সংবিধানকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে হবে। সংবিধানের ওপর একটি রাষ্ট্রে কোনো আইন থাকতে পারে না। এমন কোনো নজির সৃষ্টি করা ঠিক হবে না, যাতে ভবিষ্যতে আবার কেউ সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিতে পারে। যারা পিআর পদ্ধতি চান, তাদের এর পক্ষে জনমত তৈরি করতে হবে। নির্বাচনে যদি জনগণ পিআর পদ্ধতি চায় তবে অবশ্যই তারা জামায়াতের পক্ষে ভোট দেবে। জয়ী হয়ে সংসদে গিয়ে, পিআর পদ্ধতি চালু করা তাদের জন্য হবে সহজতম পথ। একটা কথা মনে রাখতে হবে, এ মুহূর্তে সংবিধান পরিবর্তনের সুযোগ নেই। কারণ গত বছরের ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে বর্তমান সংবিধানের অধীনে। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সের আলোকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন এবং প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্যান্য উপদেষ্টাদের শপথবাক্য পাঠ করান। রাষ্ট্রপতি সংসদও ভেঙে দেন। তাই বিদ্যমান সংবিধানের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। অনেকেই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে চলমান নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের আবেদনের রিট পিটিশন প্রসঙ্গ তুলে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির শঙ্কা করছেন। তাদের মতে, সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহালের পক্ষে রায় দিলে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে, তার অধীনে নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু এ ধরনের ব্যাখ্যার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল করতে বললেও সেই রায় কার্যকর করতে হবে সংসদকে। এ প্রসঙ্গে আমরা সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বাতিলের রায় কার্যকর করার পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে পারি। সর্বোচ্চ আদালত অষ্টম সংশোধনী বাতিল করে দিলে সংসদে রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধন করা হয়। এরকম অনেক উদাহরণ আছে। আমি সে প্রসঙ্গে এখন যেতে চাই না। শুধু এটুকু বলতে চাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত রায়েই সর্বোচ্চ আদালত রায় কার্যকর করার পথ বলে দেবেন। কাজেই এ নিয়ে আগাম অনুমান করার সুযোগ নেই। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সের মাধ্যমে গঠিত এ অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এ সরকার কোনো সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোট- কোনোটাই করতে পারবে না। নির্বাচনই এ সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের একমাত্র বৈধ উপায়। এ সত্য যেমন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান জানেন, তেমনি জানে রাজনৈতিক দলগুলোও। এজন্যই ড. ইউনূস বারবার বলছেন, ‘নির্বাচন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই’। কিন্তু যারা এসব দাবি তুলছেন তারা অবিশ্বাস এবং বিএনপিকে চাপে ফেলতে এ দাবি মাঠে এনেছেন। এ রাজনৈতিক কৌশল দেশের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু করেছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলে এ সরকার রুটিন দায়িত্বে থাকবে। তখন জুলাই সনদ গ্রহণ বা এতে স্বাক্ষর করা যাবে না। তাই সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যেই এই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
এই সময়ে প্রধান উপদেষ্টা নিউইয়র্ক সফরে তিন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। লন্ডনে যেভাবে তিনি নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা দূর করেছেন, ঠিক তেমনি নিউইয়র্কে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে দেশকে নির্বাচনের পথে নিয়ে যাবেন বলেই সবার প্রত্যাশা।
অদিতি করিম : লেখক ও নাট্যকার
ইমেইল : [email protected]