আমাদের দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই বয়সজনিত হাড় ক্ষয়রোগে আক্রান্ত। হাড় ক্ষয় ছাড়াও জয়েন্ট বা অস্থি-সন্ধির অভ্যন্তরীণ উপাদান যেমন- সাইনোভিয়াল ফ্লুইডও কমে। যার ফলে শরীরের জয়েন্টগুলোয় ব্যথা-বেদনা দেখা দেয়। বিশেষ করে মেরুদণ্ড, ঘাড়, কোমর, হাঁটু, কাঁধ ইত্যাদিতে বেশি ব্যথা অনুভূত হয়।
বার্ধক্য কোনো রোগ নয়। এটা জীবনের একটি প্রক্রিয়া। জন্মিলে মরতে হবে যেমন সত্য, তেমনি বেঁচে থাকলে বার্ধক্য আসবে। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমাদের দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই বয়সজনিত হাড় ক্ষয়রোগে আক্রান্ত। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হাড়ের ক্ষয়ও বৃদ্ধি হতে থাকে। বিশেষ করে মহিলাদের মেনোপেজ-পরবর্তীতে হাড়ের ক্ষয় দ্রুত হতে থাকে। এই হাড়ের ক্ষয় ছাড়াও জয়েন্ট বা অস্থি-সন্ধির অভ্যন্তরীণ উপাদান যেমন- সাইনোভিয়াল ফ্লুইডও কমে। যার ফলে শরীরের জয়েন্টগুলোয় ব্যথা-বেদনা দেখা দেয়। বিশেষ করে মেরুদণ্ড, ঘাড়, কোমর, হাঁটু, কাঁধ ইত্যাদিতে বেশি ব্যথা অনুভূত হয়। যা মেডিকেল পরিভাষায় স্পন্ডাইলোসিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিস, অস্টিওপরোসিস ইত্যাদি বলা হয়।
স্পন্ডাইলোসিস
এটি মেরুদণ্ডের হাড় বা কশেরুকার ক্ষয়জনিত রোগ। আমাদের মেরুদণ্ড সবচেয়ে বেশি নড়াচড়া হয়, দুইটি অংশে ঘাড় বা সারভাইক্যাল স্পাইন ও কোমর বা লাম্বার স্পাইন। যেহেতু সারভাইক্যাল স্পাইন ও লাম্বার স্পাইনে মুভমেন্ট বা নড়াচড়া বেশি হয়। এর ফলে মেরুদণ্ডের এই অংশে হাড়ের ক্ষয়ও বেশি হয়ে থাকে। ঘাড়ের মেরুদণ্ডের এই ক্ষয় হয়ে যাওয়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সারভাইক্যাল স্পন্ডাইলোসিস বলা হয় এবং কোমরের মেরুদণ্ডের এই ক্ষয় হয়ে যাওয়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস বলা হয়।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস
‘অস্টিওআর্থ্রাইটিস’ এটি একটি অস্থি-সন্ধির ক্ষয়জনিত রোগ। আমাদের অস্থি-সন্ধি বা জয়েন্ট এক ধরনের নরম কাভার দ্বারা আবৃত থাকে। যাকে মেডিকেল ভাষায় কারটিলেজ বলে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কারটিলেজগুলো ক্ষয় হতে থাকে, জয়েন্ট বা অস্থি-সন্ধির মার্জিন অমসৃণ হয়ে যায়। জয়েন্ট বা অস্থি-সন্ধির গ্যাপ কমে যায়, যার ফলে জয়েন্ট বা অস্থি-সন্ধি নাড়াচাড়া করতে ব্যথা অনুভূত হয়। ‘অস্টিওআর্থ্রাইটিস’ বিভিন্ন জয়েন্ট বা অস্থি-সন্ধিতে হতে পারে। তার মধ্যে
- কব্জি বা রিস্ট জয়েন্ট
- হিপ জয়েন্ট
- হাঁটু বা নি জয়েন্ট
- সারভাইক্যাল স্পাইন
- লাম্বার স্পাইন ইত্যাদি
হাঁটু আমাদের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওজন বহনকারী জয়েন্ট বিধায় হাঁটুতে ‘অস্টিওআর্থ্রাইটিস’ বেশি হয়ে থাকে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ৫০-এর অধিক বয়সের বেশির ভাগ মানুষ হাঁটুর ব্যথায় ভুগে থাকেন। যার অন্যতম কারণ হলো ‘অস্টিওআর্থ্রাইটিস’।
অস্টিওপোরোসিস
অস্টিওপোরোসিস বা অস্থি ক্ষয় বা হাড়ের ক্ষয়রোগ এমন একটি অসুখ যার ফলে হারের ঘনত্ব নির্দিষ্ট মাত্রায় কমে যাওয়ায় হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। ২০ থেকে ৩৫ বছর হাড় তার পূর্ণতা লাভ করে, তারপর ৪০ বছরের পর থেকে হাড় তার ক্যালসিয়াম ও ফসফেট হারাতে থাকে। এর ফলে হাড়ের পরিবর্তন হয়, দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। ৫০ বছর বয়সে ১৫ ভাগ এবং ৭০-৮০ বছর বয়সে ৩০ ভাগ মহিলার হিপ বোন বা নিতম্বের হাড় ভেঙে যায় । তবে পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সারা বিশ্বে ৫০ বছরের অধিক বয়সের প্রতি তিনজন মহিলার মধ্যে একজন এবং প্রতি পাঁচজন পুরুষের একজনের অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয়রোগ হয় । এই ব্যথার ফলে রোগীদের ব্যক্তিগত কাজকর্ম যা মেডিকেল পরিভাষায় ডেইলি এক্টিভিটিজগুলোও করতে পারে না। যেমন : বসা থেকে উঠতে না পারা, নিচে বসতে না পারা, সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করতে না পারা, টয়লেটে বসতে অসুবিধা ইত্যাদি সমস্যায় ভুগে থাকেন।
চিকিৎসা
সমস্যাগুলোর চিকিৎসা হলো ওষুধ। যেমন : এন এস আই ডি, এসডায়েটরি সাপ্লিমেন্ট-গ্লুকোসামিন হাইড্রোক্লোরাইড, কন্ড্রোটিন সালফেট, ক্যালসিয়াম, হ্যালুরনিক অ্যাসিড ইত্যাদি। বয়স্ক লোকদের যেহেতু এই রোগ বেশি হয় সেহেতু ওষুধের ব্যবহার যত কম করা যায় তত ভালো। তাই ওষুধের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি ও থেরাপিউটিক ব্যায়াম যা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীনভাবে সমস্যাগুলো কমিয়ে এনে রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাপনের উপযোগী করে তুলবে। রোগীর মাংসপেশির শক্তি বজায় রাখার জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ফিজিওথেরাপি বা চিকিৎসকের নির্দেশিত ব্যায়ামগুলো নিয়মিত করলে ব্যথা-বেদনা কমিয়ে আনা সম্ভব।
লেখক-
ডা. এম ইয়াছিন আলী
কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধান, ফিজিওথেরাপি, ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা।