বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আলু অন্যতম প্রধান খাদ্য উপাদান। যদিও আলু একটি সব্জি জাতীয় খাদ্য উপাদান হলেও মূলত শর্করা জাতীয় খাবারের জন্যই খাদ্য হিসেবে আলু ও ভাত আমাদের কাছে সমাদৃত। ছোলাসহ ১০০ গ্রাম আলুতে থাকে ৮০ ক্যালোরি। শর্করা ১৯ গ্রাম, পানির পরিমাণ ৭৫ গ্রাম, আমিষ ২ গ্রাম, চর্বি ১০ মি. গ্রাম, ফাইবার ২.২ গ্রাম। আলুতে ভিটামিন সি বেশি- ২০ মি. গ্রাম/ ১০০ গ্রাম, থায়ামিন, রিবফ্লেভিন, নায়াসিন, বি-৬, যথাক্রমে-০.০৮, ০৩, ১.১ ও ২৫ মি. গ্রাম। ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস যথাক্রমে ১২, ১.৮, ২৩, ৫৭ মি. গ্রাম। পটাশিয়াম বেশি ৪২১ মি. গ্রাম, সোডিয়াম ৬ মি. গ্রাম। আলুর চোচায় খাদ্যের প্রয়োজনীয় আঁশের প্রায় অর্ধেক থাকে। ৫০% এর বেশী খাদ্য উপাদান মূল আলুতে থাকে। অধিকাংশ আলুর খাবারই গরম পরিবেশিত হয়, যা অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত।
শর্করার পরিমাণ ভাতে আলুর চেয়ে বেশি। কিভাবে খাবার সরবরাহ করা হয় তার উপরেও ওই খাদ্যের ক্যালরির মাত্রা নির্ভর করে। রকমারি পরিবেশনার জন্য আলুর ক্যালরি তারতম্য হয়।
বিভিন্ন খাবারের তুলনামূলক ক্যালরি হিসাব:
১০০ গ্রাম ভাতে আছে ১১৬ ক্যালোরি, ১০০ গ্রাম আলুতে (ভাপে সেদ্ধ) আছে ৭৩ ক্যালোরি, ১০০ গ্রাম আলুতে (পানিতে সেদ্ধ) আছে ৭৩ ক্যালোরি, ১০টা আলুর চিপে আছে ১১০ ক্যালোরি, ১০টা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইতে আছে ১০ ক্যালোরি, ১০০ গ্রাম আপেলে ৫৩ ক্যালোরি, ১ কাপ লো ফ্যাট মিল্ক এ ১৫০ ক্যালোরি, ১ কাপ নুডলসে ২০০ ক্যালোরি, ১ পিস রুটিতে ৭০ ক্যালোরি, ১ কাপ টক দইতে ১০০ ক্যালোরি।
সার্বিক বিবেচনায় (ক্যালোরি, কার্বহাইড্রেট, ভিটমিন খাদ্য হিসেবে আলু ও ভাত কাছাকাছি। খরচ হিসেব করলে আলু অনেক সস্তা ও কম মূল্যে এক উপকারী (সাশ্রয়ী) ভেজিটেবল প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল সোর্স। আমাদের প্রতিদিনের খাবারে আলু তাই একটা সাশ্রয়ী সংযোজন হতে পারে। আলু জন্মানো সহজ, ফলন অনেক বেশী। সব কিছু বিবেচনা করেই হয়তো জাতিসংঘ ২০০৮ সালকে বিশ্ব আলু বর্ষ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
মাঝারি (১৫০ গ্রাম) একটি আলু থেকে আমেরিকানদের দৈনিক খাবারের প্রোটিনের ৬%, ভিটামিন সি'র ৫০% থায়ামিনের ৮%, রিবফ্লাভিন এর ২%, নিয়াসিনের ১০%, আয়রনের ৮%, ভিটামিন বি-৬ এর ১৫%, ফলিক এসিডের ৮%, ফসফরাসের ৮%, ম্যাগনেশিয়ামের ৮%, জিংকের ২%, কপারের ৮%, প্যান্টথেনিক এসিডের ৮% এবং আয়োডিনের ১৫% আসে। একটি মাঝারি আকারের আলু (১৫০ গ্রাম) প্রতিদিনের ক্যালরির ৪-৫% পেলেও আলু থেকে আমরা অনেক বেশী পরিমাণ অন্যান্য উপাদেয় ভিটামিন, ভেজিটেবল প্রোটিন, মিনারেল পাই। আলু ভক্ত কেউ যদি ২টা বা বেশি খায় তাহলে তো কথাই নেই। বেলোরুশিয়ার লোক সবচেয়ে বেশি আলু খায়। যে কোন আমেরিকান বছরে ১২০ পাউন্ড আলু খায়।
ডায়াবেটিস ও আলু: ডায়াবেটিস রোগীদের খাবারকে আমরা তিন শ্রেণীতে ভাগ করি। ভাত, আলু ইত্যাদি কমপেক্স কার্বহাইড্রেট বেশি পরিমাণে খাওয়া যায়। চর্বি জাতীয় খাবার চিনি ও গ্লুকোজ না খাওয়া ভাল। দুধ, মাংস, মাংস জাতীয় খাবার যত কম তত ভাল। কোন খাবার খেলে রক্তে কতটুকু গ্লুকোজ বাড়ে ওই খাবারের গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স দিয়ে তা বোঝা যায়। সে খাবারের গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স যত বেশি সেই খাবার তত বেশি গ্লুকোজ বাড়ায়। ভাত ও আলু দুটাই হাই ইন্ডেক্স খাবার। লাল চালের ভাত, মধু, আলু পাকা কলা, পাকা আম, পাকা পেপেরগ্লিাইসেমিক ইন্ডেক্স ৮০ থেকে ৯০। সাদা চালের (পোলিশড) ভাত, কর্ন, ফ্লেকস, আইসক্রিমের ইনেডেক্স ১০০। আলু, গাজর, অ্যাপিকটের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৮০-৯০, গম, সীমের বিচির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৭০-৯০, কমলার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৪০-৪৯, আপেল, ফ্যাট ফ্রি দুধ-এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৩০-৩৯।
রক গ্লুকোজ বাড়ানোর ক্ষমতা অনুসারে আগে খাদ্যদ্রব্যকে কমপেক্স ও সিম্পল এ দুইভাগে ভাগ করা হত, এখন গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স ও গ্লাইসেমিক লোড দিয়ে খাদ্যের গ্লুকোজ বাড়ানোর ক্যাপাসিটি নির্ণয় করা হয়। কোন একটা খাবারের যে পরিমাণে ৫০ গ্রাম কার্বহাইড্রেট থাকে এবং সেই পরিমাণ খাবার খেলে ঐ খাবার রক্তে যতটুকু গ্লুকোজ বাড়ায় তার সাথে ৫০ গ্রাম পিওর গ্লুকোজ খেলে রক যে পরিমাণ গ্লুকোজ বাড়ে সেটার তুলনাই হল গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স। বলার অপেক্ষা রাখে না কোন খাবার থেকে কতটুকু ক্যালরি পাওয়া যাবে তা নির্ভর করে এ খাবারের শর্করা ও অন্যান্য জিনিসের (যেমন-ফ্যাট, প্রোটিন ইত্যাদির পরিমাণের উপর) । আলু লো ক্যালরি, লো ফ্যাট এবং ভেজিটেবল প্রোটিন, মিনারেল ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার। তাই সার্বিক বিবেচনায় খাদ্য হিসেবে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য আলু খারাপ নয়। তবে আলু কিভাবে পরিবেশন হচ্ছে সেটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
আলু ও হাইপারটেনশন: আলুতে কুকোএ্যমিন ও কিছু রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা ব্লাড প্রেসার কমায়। ফোটানো (বয়েলড) আলুতে ভাজা (ফ্রাইড) আলুর চেয়ে এই কেমিক্যালস বেশী থাকে। আলুতে প্রায় শূন্য পরিমাণ ফ্যাট, পানি বেশি, আলু খেলে মোটা হয়ে যাবো এ ধারণা ঠিক নয়।
আলু সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যপযোগী। তাই আলু খাবার অভ্যাস করতে হবে। বেশি করে আলু খেতে হবে। মধ্যাহ্ন ভোজে অর্ধেক ভাত ও অর্ধেক আলু খাওয়া যেতে পারে। হাইব্রিড সবরীর যুগে আমরা সাগর কলাতেই স্বাদ মেটাই, আসল সবরী কলা আর খুঁজি না। আসল কথা হলো প্রয়োজন এবং বাস্তবতা সময়ের তাগিদে আমাদেরকে অভ্যাস বদলাতে হয়েছে, হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
বিডি-প্রতিদিন/ ২৪ এপ্রিল, ২০১৬/ রশিদা