এন্ডোমেট্রিয়াম জরায়ুর সবচেয়ে ভিতরের স্তর যা মাসিকের সময় রক্তের সাথে বের হয়ে যায়। এই স্তরটি দুটি হরমোন ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের প্রতি সংবেদনশীল। এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু বা শরীরকলা জরায়ুতে না হয়ে ডিম্বনালী (ফ্যালোপিয়ান টিউব), ডিম্বাশয় বা অন্য কোনো কারণে এন্ডোমেট্রিওসিসের সৃষ্টি হয়। এটি খুবই কষ্টদায়ক অবস্থা যা মাঝে মাঝে এতটাই গুরুতর হয়ে থাকে যে জরায়ুর অঙ্গাণুগুলি একে অন্যের সাথে লেগে যায়।
প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গ
এন্ডোমেট্রিওসিসের উপসর্গগুলো নির্ভর করে এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যুগুলি কোথায় সৃষ্টি হয়েছে তার উপর। এন্ডোমেট্রিওসিসের কিছু সাধারণ উপসর্গ নিচে উল্লেখ করা হলো-
১. মাসিকের সময় পেটে প্রচণ্ড ব্যথা (Dysmenorrhea)। অনেকের সবসময় পেটে ব্যথা থাকে।
২. যৌন মিলনের সময় ব্যথা (Dyspareunia)
৩. মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ (Menorrhagia) বা দীর্ঘকালীন রক্তক্ষরণ (Metrorrhagia)
৪. বন্ধ্যাত্ব।
৫. মূত্রত্যাগ ও মলত্যাগের সময় ব্যথা অনুভব করা।
৬. এছাড়াও দুর্বলতাবোধ, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, বমি বমি ভাব বিশেষত পিরিয়ড চলাকালীন অবস্থায় হতে পারে।
প্রধান কারণগুলো কী কী?
এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু যখন ডিম্বনালী, ডিম্বাশয় বা জরায়ুর অন্য কোনো স্থানে সৃষ্টি হতে শুরু করে তখন এন্ডোমেট্রিওসিস হয়।
এটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে:
১. মাসিকচক্রের রক্ত যখন শরীরের বাইরে না বেরিয়ে ভিতরে প্রত্যাবর্তন করে ও বিপরীত গতিতে ডিম্বনালী বা ডিম্বাশয়ে ফিরে আসে তখন ডিম্বনালী বা ডিম্বাশয়ে এন্ডোমেট্রিয়াল কোষ জন্মাতে শুরু করে।
২. অপারেশনের ফলে প্রতিস্বাধন: সিজারিয়ান পদ্ধতিতে প্রসবকালে অপারেশন বা হিস্টারোস্কোপিতে, এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু উক্ত জায়গায় জন্মাতে পারে।
৩. পেরিটোনিয়াল কোষের পরিবর্তন: কিছু রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত জটিলতা বা হরমোনগত কারণে, পেরিটোনিয়াল কোষ এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যুতে পরিবর্তিত হয়।
৪. এন্ডোমেট্রিয়াল কোষ: এন্ডোমেট্রিয়াল কোষ অন্য কোনো অঙ্গে পৌঁছাতে পারে রক্ত বা লসিকার মাধ্যমে।
৫. এন্ড্রাজেনিক কোষের রূপান্তর: বয়ঃসন্ধিকালে ইস্ট্রোজেনের কারণে, এন্ড্রাজেনিক কোষ এন্ডোমেট্রিয়াল কোষে রূপান্তরিত হয়। যাদের এন্ডোমেট্রিওসিস হবার উচ্চ ঝুঁকি আছে: মা, বোন, কন্যা-এমন কারো এই রোগটি থেকে থাকলে, ৩০ বছর বয়সের পরে যদি কোনো নারী তার প্রথম বাচ্চার জন্ম দিয়ে থাকেন, জরায়ুতে কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা থাকলে, স্বাভাবিক সময়ের আগেই বারবার পিরিয়ড শুরু হলে।
৬. পিরিয়ড অনেক দিন ধরে চললে অথবা পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হলে।
এন্ডোমেট্রিওসিস হলে পরবর্তীতে যে সমস্যাগুলো হতে পারে।
এটি কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
সম্পূর্ণ চিকিৎসাগত ইতিহাস ও সম্পূর্ণ শারীরিক পরীক্ষা সাধারণত এন্ডোমেট্রিওসিস শনাক্তকরণে সাহায্য করে। তা সত্ত্বেও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় রোগটিকে নিশ্চিত করতে এবং এই রোগ কতটা ছড়িয়েছে তা দেখার জন্য:
১. তলপেটের আল্ট্রাসাউন্ড: এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু তলপেটের কোনো অঙ্গে হয়েছে কিনা তা সঠিকভাবে নির্ণয় করার জন্য।
২. ট্রান্সভ্যাজাইনাল আল্ট্রাসাউন্ড: এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যুর উপস্থিতি সঠিকভাবে নির্ণয় করার জন্য করা হয়।
৩. ল্যাপারোস্কোপি: এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু এন্ডোস্কোপের সাহায্যে দেখা হয় ও তার সাথে বায়োপসি করে পরীক্ষাটিকে নিশ্চিত করা হয়।
৪. এম আর আই: এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু যে স্থানটিতে সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষভাবে Adenomyoma এবং Focae Adenomyoma সেটির অবস্থান ও আকৃতি নির্ণয় করতে সাহায্য করে।
৫. বায়োপসি: ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে করে টিস্যুর একটি নমুনা অপসারণ করতে ও পরবর্তীতে আরও পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগারে পাঠাতে হয়।
চিকিৎসা পদ্ধতি:
১. মাসিকের সময় ব্যথা কমানোর ওষুধ সেবনের মাধ্যমে।
২. হরমোন থেরাপি: ব্যথা কমাতে, মাসিক নিয়মিত হওয়া ও মাসিকের রক্তপ্রবাহ কমানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। হরমোনের ওষুধগুলি এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যুর বৃদ্ধিকে বন্ধ করে দিতে পারে এবং নতুন এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু ইমপ্লান্ট গঠনে বাধা দিতে পারে।
৩. সার্জারি: অপারেশনের দ্বারা রূপান্তরিত এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু বাদ দেওয়া হয়। গুরুতর ক্ষেত্রে, জরায়ু, ডিম্বাশয় ও ডিম্বনালী (ফ্যালোপিয়ান টিউব) সহ অপারেশন করে বাদ দেওয়া হয়। (Hysterectomy + BSO)
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন? উল্লেখিত লক্ষণগুলো মিলে গেলে যতদ্রুত সম্ভব একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। রোগের শুরুতেই ধরা পড়লে।
লেখক: স্ত্রীরোগ, প্রসূতিবিদ্যা ও বন্ধ্যাত্ব রোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন
আলোক মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার, মিরপুর-৬