বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদযাপিত হলো বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পেশাজীবী সংগঠনসমূহ নানা আয়োজন করে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো- “দুর্বলতা এবং পতন প্রতিরোধের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সুস্থ বার্ধক্যের ফিজিওথেরাপি এবং শারীরিক কার্যকলাপের ভূমিকা।”
ফিজিওথেরাপি দিবসের তাৎপর্য
১৯৯৬ সাল থেকে প্রতি বছর ৮ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস। মূল উদ্দেশ্য হলো- সাধারণ মানুষকে ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা। আধুনিক চিকিৎসার এই শাখা শুধু রোগ নিরাময়েই নয়, রোগ প্রতিরোধ, পুনর্বাসন ও জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৬০ বছর বা তদূর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এ প্রবণতা স্পষ্ট। ফলে বার্ধক্যে সুস্থতা বজায় রাখা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
বার্ধক্যের শারীরিক পরিবর্তন
বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরে নানা পরিবর্তন ঘটে। যেমন-
পেশিশক্তি দুর্বলতা : দৈনন্দিন কাজ যেমন হাঁটা বা উঠা- বসা কঠিন হয়ে যায়।
হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া : সামান্য আঘাতেই হাড় ভেঙে যেতে পারে।
জয়েন্টের ব্যথা : হাঁটু, কোমর সহ শরীরের অন্য জয়েন্টে ব্যাথা অনুভব হয়।
ভারসাম্য কমে যাওয়া : সহজেই পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
কার্ডিও-রেসপিরেটরি দুর্বলতা : সামান্য পরিশ্রমেই ক্লান্তি বোধ হওয়া।
মানসিক প্রভাব : অবসাদ, উদ্বেগ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।
এসব পরিবর্তন শুধু শারীরিক অসুবিধাই নয়, বরং জীবনমান, আত্মসম্মান ও সামাজিক অংশগ্রহণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
প্রবীণদের ঝুঁকি ও সামাজিক প্রভাব-
প্রবীণ বয়সে দৈনন্দিন কাজ সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এর ফলে চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পায়, পরিবারের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ে, আত্মবিশ্বাস ও মানসিক শক্তি হ্রাস পায়। ফলে সুস্থ বার্ধক্য নিশ্চিত করা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্বও বটে।
ফিজিওথেরাপির ভূমিকা-
১. পেশি ও হাড় শক্তিশালী করা- নিয়মিত ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে মাংসপেশির শক্তি বাড়ায়, হাড় মজবুত রাখে এবং জয়েন্ট সচল রাখে।
২. ভারসাম্য উন্নয়ন- বিশেষ ব্যায়ামের মাধ্যমে প্রবীণদের পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমানো যায়।
৩. হৃদ্যন্ত্র ও শ্বাসযন্ত্রের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি- ফিজিওথেরাপি নিয়মিত করলে শরীরচর্চা ও শ্বাসপ্রশ্বাস অনুশীলনের মাধ্যমে হৃদ্যন্ত্র ও ফুসফুসের কার্যক্ষমতা উন্নত হয়।
৪. মানসিক স্বাস্থ্য- শারীরিক কার্যকলাপের ফলে এন্ডরফিন নিঃসৃত হয়, যা মন ভালো রাখে ও মানসিক চাপ কমায়।
প্রতিরোধই শ্রেষ্ঠ উপায়-
সুস্থ জীবনধারা : নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্য ও পর্যাপ্ত ঘুম অপরিহার্য।
প্রাথমিক প্রতিরোধ : ৪০-৫০ বছর বয়স থেকেই ফিজিওথেরাপি চর্চা করলে বার্ধক্যের সমস্যাগুলো অনেকাংশে প্রতিরোধযোগ্য।
সচেতনতা বৃদ্ধি : পরিবার ও সমাজে প্রবীণবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপির সম্ভাবনা-
বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ফিজিওথেরাপি শিক্ষা ও চিকিৎসা কার্যক্রম চালু থাকলেও গ্রামীণ পর্যায়ে এর প্রসার অপর্যাপ্ত। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য ফিজিওথেরাপি সেবা সম্প্রসারণ এবং গণসচেতনতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।
বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়-
সুস্থ ও কর্মক্ষম বার্ধক্য গঠনে ফিজিওথেরাপির কোনো বিকল্প নেই। বার্ধক্যের প্রাকৃতিক পরিবর্তন এড়ানো না গেলেও নিয়মিত ফিজিওথেরাপি ও শারীরিক কার্যকলাপের মাধ্যমে প্রবীণরা আরও সক্রিয়, স্বনির্ভর ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারেন। একজন প্রবীণ সুস্থ থাকলে উপকৃত হয় তার পরিবার, সমাজ এবং দেশ। তাই সুস্থ বার্ধক্যের জন্য ফিজিওথেরাপি হোক সবার অঙ্গীকার।
লেখক: ডিজাবিলিটি ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিষ্ট, সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রিএ্যাকটিভ হাসপাতাল, তেজগাঁও, ঢাকা।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ