বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

অপার সম্ভাবনার বাংলাবান্ধা

সরকার হায়দার, পঞ্চগড়

অপার সম্ভাবনার বাংলাবান্ধা

বাংলাদেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যতগুলো স্থলবন্দর রয়েছে ভৌগোলিক কারণে এই স্থলবন্দরের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। এই বন্দর দিয়ে বর্তমানে ৪ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ৫৪ কিলোমিটার, ভুটান ১৩০ কিলোমিটার এবং চীনের দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর পেরোলেই ৮ কিলোমিটার দূরে ভারতের শিলিগুড়ি শহর। এই শহর থেকে সড়ক, রেল এবং আকাশপথে ভারতের যে কোনো রাজ্যে যাওয়া যায়। ভারতের সেভেন সিস্টার্সের রাজ্যগুলোতে প্রবেশের একমাত্র করিডোর এই শিলিগুড়ি।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের বীজ রোপিত হয় ১৯৭৪ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে ঐতিহাসিক মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে। ১৯৯৭ সালে নেপাল এবং ২০১১ সালে ভারতের সঙ্গে শুরু হয় ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যক্রম। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি ভুটান থেকে পাথর আমদানির মধ্য দিয়ে শুরু হয় স্থলবন্দরের সঙ্গে চতুর্দেশীয় ব্যবসা কার্যক্রম। বন্দরটি চালুর প্রথম দিকে কয়েক বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় কম হলেও পরবর্তীতে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে চার দেশীয় স্থলবন্দরে ব্যবসা-বাণিজ্যে আদায় হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ রাজস্ব।

দার্জিলিং এই বন্দর থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বাংলাদেশের ভারতে চিকিৎসারত বিপুল সংখ্যক রোগী, পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা এই বন্দর ব্যবহার করে নানা সুবিধা পাচ্ছেন। পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থান দার্জিলিং, গ্যাংটক, ডুয়ার্স, সিকিম, ভুটান এই বন্দরের অত্যন্ত কাছে। অন্যদিকে এই বন্দর ব্যবহার করে ভারত, নোপাল, ভুটান এবং চীনের পর্যটকরা খুব সহজে বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তে ঘুরতে পারেন। দেশ ভাগের সময় দুই দেশের বিপুল জনগণের আত্মীয় স্বজন দুই দেশে রয়ে গেছে। এই বন্দর দিয়ে ইমিগ্রেশন চালুর পর হাজার হাজার মানুষ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন। ভারত, নেপাল, ভুটান এবং সিকিমে প্রচুর পরিমাণে পর্যটক ভ্রমণ করছেন।

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছেন, গত বছরের জুলাইয়ে পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ৯৫২ মেট্রিক টন। চলতি বছরের জুনে সেই পরিমাণ ১ লাখ ৫৪ হাজার ১৭৯ মেট্রিক টন। গত এক বছরে এ বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছে ৯২৭ কোটি ৭৭ লাখ ১৯ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকার পণ্য।

২০২১-২০২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। করোনা সংকট এবং বৈশ্বিক অস্থিরতায় এই বছর রাজস্ব আদায় কমে যায়। এই অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয় ৪১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। রাজস্ব আদায় হয় ৬১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৩১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আদায় করা হয় ২১ কোটি ৬৪ লাখ ৩ হাজার টাকা। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে নির্ধারণ করা হয় ৩৬ কোটি ৭৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮১১ টাকা, আদায় হয় ২৫ কোটি ৭৩ হাজার টাকা। ২০১৭-১৮ সালের অর্থবরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২০ কোটি টাকা, আদায় ১৮ কোটি ৭৮ লাখ ২৩ হাজার। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩৬ কোটি টাকা, আদায় হয় ১৮ কোটি টাকা।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে ৩৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয় ৬০ কোটি টাকা। আদায় করা হয় ৩৫ কোটি ৪০ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ২২ কোটি ৩৬ লাখ ৬ হাজার নির্ধারণ হলেও আদায় হয় ২৬ কোটি ৯৩ লাখ ৫৯ হাজার ২৩৯ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৯ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা থাকলেও আদায় হয়েছিল ১৩ কোটি টাকা। ২০১১-১২ সালে ৬ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ১ কোটি টাকার বেশি আদায় হয়েছিল।

কিন্তু বন্দরে রয়েছে নানা রকম সমস্যাও। রয়েছে জায়গার সংকট। আমদানিকৃত মালামালের পরিবহনগুলোকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ফলে জ্যাম সৃষ্টি হয়। কেনো কোনো পরিবহনকে সপ্তাহ থেকে মাসাধিককাল আটকে থাকতে হয়। চাহিদা মতো অবকাঠামো নির্মিত হয়নি এখনো। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বন্দর লিমিটেডের দূরত্ব রয়েছে। রয়েছে রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা। শ্রমিক হ্যান্ডলিংয়ে জটিলতা রয়েছে। এসব কারণে বন্দরটির কার্যক্রম মাঝে মাঝে স্থবির হয়ে পড়ে।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক কুদরতি-খুদা-মিলন জানান, এই স্থলবন্দরের দিকে সরকারের আরও গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। নানা রকম সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যাগুলো দূর হলে এবং সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করলে এই বন্দর দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ম্যানেজার ও বন্দর ইনচার্জ আবুল কালাম আজাদ বলেন, জায়গা সংকট রয়েছে। আরও ১২ একর জায়গা বরাদ্দের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের সহকারী কমিশনার মবিন উল ইসলাম জানান, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর   হয়ে উঠছে। স্থলবন্দরটির মধ্যে অপার সম্ভাবনা আছে। এই বন্দর দিয়ে ভবিষ্যতে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে পারলে দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর হিসেবে এখান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব।

সর্বশেষ খবর