ইউক্রেনে শেষ পর্যন্ত রুশ অভিযান অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তিনি নিশ্চিত রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাতে যাচ্ছে। কীভাবে রাশিয়া ইউক্রেনে ঢুকে পড়বে তার একটি রূপরেখাও তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সিএনএ। এদিকে এরই মধ্যে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর লুগানস্কে পরপর দুটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটেছে। এতে লুগানস্কের গ্যাস সরবরাহ লাইন বিধ্বস্ত হয়েছে। পাশাপাশি পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহীরা সীমান্তে বিপুল সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে ইউক্রেন সেনাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করেছে। ইউক্রেন দাবি করেছে এতে তাদের এক সেনা নিহত হয়েছেন। সূত্র : রয়টার্স, বিবিসি, আলজাজিরা, স্পুটনিক, পার্স টুডে, সিএনএন, এএফপি।
প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী ইউক্রেন সীমান্ত লাগোয়া পাঁচটি বিমানঘাঁটি থেকে তোলা উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে, ইউক্রেন সীমান্ত বরাবর জড়ো হয়েছে বিপুল সংখ্যায় রুশ যুদ্ধবিমান। এর মধ্যে রয়েছে সুখোই-৩০, মিগ-৩৫ যুদ্ধবিমান ও সামরিক হেলিকপ্টার। পাশাপাশি নানা সামরিক সরঞ্জামও এখানে মজুদ করা হচ্ছে। পশ্চিম রাশিয়ায় অবস্থিত রুশ বিমানঘাঁটিগুলোর পাশাপাশি ইউক্রেন থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ক্রাইমিয়া এমনকি সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অংশ বেলারুশেও রুশ বিমানবহরের উপস্থিতি নজরে এসেছে ম্যাক্সারের উপগ্রহ চিত্রে। এ ঘটনাকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ অভিযানের প্রস্তুতি বলেই মনে করা হচ্ছে। খবরে আরও বলা হয়, ইউক্রেন সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ১৪টি ঘাঁটি বানিয়েছে রুশ বাহিনী। দ্রুত সীমান্তে সেনা পাঠাতে রাতারাতি তৈরি করে ফেলা হয়েছে অস্থায়ী সেতুও। এরই মধ্যে ক্রাইমিয়ার বন্দরে দিন কয়েক আগেই পৌঁছেছে তিনটি রুশ যুদ্ধজাহাজ। মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনীর এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, এ মুহূর্তে ইউক্রেন সীমান্তে কম করে ১ লাখ ৯০ হাজার সেনা মজুদ করেছে পুতিন সরকার। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আবারও বলেছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন যে ইউক্রেনে ‘আগ্রাসন চালানোর সিদ্ধান্ত’ নিয়ে ফেলেছেন এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত এবং যে কোনো মুহূর্তে সেটা হতে পারে। তিনি বলেছেন, মার্কিন গোয়েন্দারা যেসব তথ্য পেয়েছেন তাতেই তাঁর এ বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে।
মাঠে নামছেন পুতিন : ইউক্রেন ইস্যুতে বড় আরেকটি সামরিক মহড়ার আয়োজন করতে যাচ্ছে রাশিয়া। গতকালই এ মহড়া শুরুর কথা এবং এ মহড়া সরাসরি পর্যবেক্ষণ করবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এ ব্যাপারে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মহড়ায় আন্তমহাদেশীয় ব্যালাস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের উৎক্ষেপণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তা ছাড়া দক্ষিণ সামরিক জেলার বিমানবাহিনীর পাশাপাশি উত্তর ও কৃষ্ণ সাগরের বাহিনীও এতে অংশ নেবে। বেলারুশের নেতা আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো জানান, শনিবারের (গতকালের) মহড়া দেখতে ভ্লাদিমির পুতিন নিজেও উপস্থিত থাকবেন। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ বলেন, শনিবারের মহড়া নিয়ে রাশিয়া খুবই স্বচ্ছ অবস্থানে রয়েছে। এতে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ মহড়াটিতে পুতিনের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে শক্তিশালী বিস্ফোরণ : ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর লুগানস্কে পরপর দুটি শক্তিশালী বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। শুক্রবারের এ হামলায় লুগানস্কের গ্যাস সরবরাহ লাইন বিধ্বস্ত হয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধমগুলো জানায়, প্রথম বিস্ফোরণে গ্যাস পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পরই আগুন ধরে যায়। দ্বিতীয় হামলাটি স্থানীয় একটি গ্যাস স্টেশনে ঘটেছে। লুগানস্কের পাশের শহর ডোনেস্কে রকেট হামলার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নতুন করে দুটি বিস্ফোরণ ঘটে। ডোনেস্কে গাড়িবোমার বিস্ফোরণ হয়।
পূর্ব ইউক্রেনে বিদ্রোহীদের সেনা সমাবেশ : পূর্ব ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া লুগানস্ক ও ডোনেস্কে সেনা সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন বিদ্রোহী নেতারা। দুই দিন ধরে অঞ্চলটিতে ইউক্রেনের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে রুশ সমর্থিত বিদ্রোহীদের সংঘাতের মধ্যেই এ ঘোষণা এলো। স্বঘোষিত প্রজাতন্ত্র ডোনেস্ক পিপলস রিপাবলিক (ডিপিআর) অঞ্চলের বিদ্রোহী নেতা ডেনিস পুশিলিন ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘নাগরিকদের মধ্যে যারা রিজার্ভে আছেন তাদের সামরিক কার্যালয়ে আসার অনুরোধ জানাচ্ছি। আমি সেনা সমাবেশ সংক্রান্ত একটি আদেশে স্বাক্ষর করেছি।’ এই সশস্ত্র বিদ্রোহী নেতা আরও বলেন, ‘আমরা যে বিজয়ের লক্ষ্যে হাঁটছি প্রয়োজনে তা অর্জন করব। আমরা আমাদের সবার জন্য এ বিজয় অর্জন করব। আমরা ডনবাসের পাশাপাশি সব রুশ জনগণকে রক্ষা করব।’ এই বিদ্রোহী নেতার এমন ঘোষণায় ওই অঞ্চলে উত্তেজনা আরও ছড়িয়ে পড়েছে।
এই প্রথম ইউক্রেনীয় সেনা নিহত : সীমান্তে উত্তেজনার মধ্যেই গতকাল এক সেনা নিহতের খবর নিশ্চিত করেছে ইউক্রেন। রাশিয়ার সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলমান উত্তেজনার মধ্যে এই প্রথম কোনো সেনা নিহতের খবর জানাল দেশটি। সেনার মৃত্যুর পেছনে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দায়ী করেছে ইউক্রেন। এদিকে সেনার মৃত্যু ইউক্রেনে রুশ হামলার আশঙ্কা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী জানিয়েছে, ‘বিদ্রোহীরা যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে লুগানস্ক ও ডোনেস্কের পূর্বাঞ্চলের মধ্যবর্তী শহরগুলোয় ৮২ থেকে ১২০ মিলিমিটার মর্টার শেল ছুড়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জনবহুল এলাকায় গুলি চালাচ্ছে এবং আবাসিক এলাকার কাছে তাদের আর্টিলারি সিস্টেম স্থাপন করছে।’ তবে মস্কো আনুষ্ঠানিকভাবে এসব হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে।
ইউক্রেনে সাইবার হামলা : চলতি সপ্তাহে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুটি ব্যাংকে সাইবার হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছিল দেশটির সরকার। ব্রিটিশ সরকারের অভিযোগ, রাশিয়ার গোয়েন্দারা সেই হামলা চালিয়েছেন। স্থানীয় সময় ১৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্য সরকারের তরফে বিবৃতি জানিয়ে এমন দাবি করা হয়। যদিও মস্কো সেই সাইবার হামলার দায় অস্বীকার করেছে।
রাশিয়ার দাবি পূরণ করবে না ন্যাটো : মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সামরিক জোটের মহাসচিব জেন্স স্টলটেনবার্গ গতকাল বলেছেন, ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়া যেসব দাবি জানিয়েছে ন্যাটো তা পূরণ করতে পারে না। তিনি বলেন, মস্কো ন্যাটোর এ অবস্থান জানার পরও তা নিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে। জার্মানিতে অনুষ্ঠানরত মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ন্যাটোর মহাসচিব এ কথা বলেন।
যে রুটে অভিযান চালাবে রাশিয়া : ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। রাশিয়া যদি ইউক্রেন সরকারের পতন নিশ্চিত করতে চায় তবে উত্তরের বেলারুশ ধরে হামলা চালানোর সম্ভাবনাই জোরালো। এ কথা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সিএনএর মুখপাত্র মাইকেল কফম্যান। তিনি উল্লেখ করেন, পুবে রাশিয়ার সীমান্তজুড়েই আছে হামলার পূর্ণ প্রস্তুতি। সীমান্তের পুরোটা জুড়েই রাশিয়ার সেনা ছড়িয়ে আছে। তবে কিয়েভের দিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে চেরনোবিল এড়িয়ে যেতে পারে রুশ সেনারা। অন্যদিকে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সেথ জোনসের মতে রাশিয়ার দিক থেকে হামলা চালানো হলে নভে ইউরকোভিচি বা ত্রোয়েবোর্তনো শহর থেকেই সেটা শুরু হবে। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের বেন বেরি জানান, ক্রিমিয়া ধরে যদি কিয়েভের দিকে রুশ সেনারা এগোতে থাকে তবে ইউক্রেনের বিপুল পরিমাণ সেনা দেশটির নিপার নদীর পুব পাশে আটকা পড়বে। সে ক্ষেত্রে পশ্চিম, পূর্ব ও উত্তর মিলিয়ে ইউক্রেনের যোদ্ধাদের ঘিরে ফেলতে পারবে রাশিয়ার সেনারা। এ ক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিম থেকে রুশ সেনাদের টার্গেটে থাকবে মূলত খেরসন ও ওদেসা দখল করা। সেই সঙ্গে পুবের মেলিতোপোল ও মারিওপোলও থাকবে দখলের তালিকায়। এটা সম্ভব হলে ক্রিমিয়া ও অন্য রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ সেতু তৈরি হয়ে যাবে। ক্রিমিয়ার উপকূলে এরই মধ্যে রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ঘোরাফেরা শুরু করেছে। আগ্রাসন শুরু হলে ওই জাহাজ থেকে আর্মার্ড ভেহিক্যাল ও ট্যাংক নামাতে পারবে রাশিয়া। তবে পশ্চিমাদের ধারণা, ইউক্রেনের পুবের অঞ্চলগুলোয় রুশভাষী জনগণকে ‘রক্ষা করার’ মিশন দিয়েই হামলার সূচনা হতে পারে। বেন বেরি বলেন, যুদ্ধ যত ছোট আকারেই শুরু হোক না কেন, ইউক্রেনের এয়ার ডিফেন্স ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কমান্ড অবকাঠামোও আক্রান্ত হবে।
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ