গত ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশ ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নামে আগ্রাসন শুরু করে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পরাশক্তি রাশিয়া। দুই বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি অঞ্চল দখল করে নিয়েছে রুশ বাহিনী। এরই মধ্যে উপযুক্ত অস্ত্রের অভযাবে যুদ্ধের সম্মুখভাগে চরম বিপাকে পড়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। এর ফলে সম্প্রতি আভদিভকা শহরের নিয়ন্ত্রণ হাত ছাড়া হয়েছে ইউক্রেনের।
এদিকে, যুদ্ধের এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে সরকার পতনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বলা যায়, সরকার পতনের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে দেশটি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা আশা করেছিল, তারা ক্রেমলিন থেকে পুতিনকে সরিয়ে দিতে পারবে। সরকার পরিবর্তনের সেই সম্ভাবনা এখন আরও স্পষ্ট হয়েছে, তবে তা রাশিয়ায় নয় বরং কিয়েভে।
সম্প্রতি আভদিভকার নিয়ন্ত্রণ হারানো কিয়েভের জন্য একটি বড় পরাজয়। সমগ্র পূর্ব ইউক্রেন এখন রাশিয়ার সামনে অনেকটা উন্মুক্ত। রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা বা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, যেকোনও সিদ্ধান্তের আগেই কিয়েভে সরকার পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে তা স্পষ্ট।
আভদিভকা শহরের খুব কাছাকাছি ডোনবাস অঞ্চলের রাজধানী এলাকা। ডোনেটস্কের প্রবেশদ্বারও বলা যায় শহরটিকে। ডোনেটস্ক এবং লুহানস্ক উভয়ই পূর্ব ইউক্রেনের অঞ্চল এবং এখানে বেশিরভাগ রুশ-ভাষী জনসংখ্যার বসবাস। স্থানীয় বাসিন্দারা রাশিয়ার সঙ্গেই থাকতে পছন্দ করে। ফলে এই সমগ্র অঞ্চলটিতে এখন রাশিয়ার একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হল।
আভদিভকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য চার মাস আগে হামলা শুরু করে রাশিয়া। জানুয়ারি থেকে পিছু হটতে শুরু করে ইউক্রেন সেনারা। শহরে অবস্থিত কোক প্ল্যান্টের দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠে রুশ কমান্ড। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে রুশ সৈন্যরা শহরটির দুই দিক থেকে ব্যাপক গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে। রাশিয়া যখন শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেয় তখন শহরটি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
আভদিভকা শহরটি অত্যন্ত সুরক্ষিত করে রেখেছিল ইউক্রেন এবং রাশিয়ান সেনাবাহিনীর জন্য এটি ছিল একটি কঠিন লক্ষ্য। রুশ সেনারা শহরটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং অস্ত্র ও খাদ্যের সরবরাহ পথ বন্ধ করে দেয়। রাশিয়ার এই কৌশল কার্যকর হয় এবং চতুর্মুখী আক্রমণে এক সময় শহরে অবস্থান করা ইউক্রেন সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়ে। এক পর্যায়ে সৈন্যদেরকে শহর থেকে বের করে নেয় কিয়েভ।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জন্য এই শহরটি ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধে কিয়েভ টিকে থাকতে পারবে কিনা তা এই শহরটির ওপর নির্ভর করছিল। ফলে যেকোনও মূল্যে জেলেনস্কি শহরটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। আভদিভকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট না হয়ে জেলেনস্কি তার সেনাপ্রধান জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনিকে বরখাস্ত করেছিলেন। পরিবর্তে তিনি দায়িত্ব দেন জেনারেল সিরস্কি-কে। সিরস্কির যুদ্ধ কৌশলে এর আগে বাখমুতের পতন ঘটেছিল এবং সেখানে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনি চেয়েছিলেন ইউক্রেনীয় বাহিনীকে এখনকার অবস্থান থেকে পিছিয়ে এনে সুরক্ষিত জায়গাগুলোতে শক্তি বৃদ্ধি করতে। যাতে কিয়েভ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোকে রক্ষা করা যায়। কিন্তু জেলেনস্কি আভদিভকা রক্ষায় সেখানে আরও সৈন্য পাঠান। আভদিভকা রুশ সৈন্যরা দখল করে নিয়েছে এবং ইউক্রেন বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
আভদিভকা রাশিয়ার দখলে চলে যাওয়া শুধু ইউক্রেনের জন্যই নয়; পশ্চিমা দাতাদের জন্যও হতাশার। অস্ত্র সরবরাহ আর সৈন্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে ইউক্রন সেনাদের মনে। ভবিষ্যতে কিয়েভকে সহায়তা করা নিয়ে দেখা দিতে পারে অনিশ্চয়তা।
মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে যাওয়ার জন্য অভিবাদন গ্রহণ করেছিলেন জেলেনস্কি। ইউক্রেনীয়রা আশা করেছিল কনফারেন্স থেকে তারা বড় ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস পাবেন। কিয়েভ ত্যাগ করার আগে জেলেনস্কি জেনারেল সিরস্কিকে নির্দেশ দিয়ে যান যাতে যেকোনও মূল্যে আভদিভকা শহরকে রক্ষা করা হয়।
শহর রক্ষায় ইউক্রেন সামরিক বাহিনীর ৩নং ব্রিগেডকে পাঠান জেনারেল সিরস্কি। প্রকৃতপক্ষে আজভ ব্রিগেডকে নতুন করে সাজিয়ে গঠিত হয়েছে এই ৩নং ব্রিগেড। এই ব্রিগেড ইউক্রেনে জেলেনস্কির অতি-জাতীয়তাবাদী সমর্থনের মেরুদণ্ড। আর জেলেনস্কির রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্ভর করে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এবং বিশেষ করে অতি-জাতীয়তাবাদীদের ওপর।
রুশ বাহিনীর সঙ্গে যদি ইউক্রেনের কোনো সৈন্যদল সমানে সমানে লড়াই করতে পারে তবে সেটি ৩নং ব্রিগেড অর্থাৎ আজভ ব্রিগেড। আজভ ব্রিগেডের সৈন্যরা যখন উত্তর দিক থেকে আভিদিভকায় প্রবেশ করে তখন তারা শহরের পরিস্থিতি ভয়ানক দেখতে পায়। সে সময় শহরের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ৪৫০০ ইউক্রেনীয় সৈন্য অবস্থান করছিল এবং তাদের বেশিরভাগই কোক প্ল্যান্টে আটকা পড়ে ছিল। ৩৫০০ ইউক্রেনীয় সৈন্য শহরের কেন্দ্র এবং অন্যান্য জায়গায় বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল।
এসব সৈন্যরা আজভ ব্রিগেডের আদেশ অমান্য করে এবং সিরস্কি ও জেলেনস্কির সুস্পষ্ট আদেশকে পিঠ দেখিয়ে শহরের বাইরে পালিয়ে যায়। মিউনিখ সম্মেলনে থাকার সময় কোনওভাবেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে চাননি জেলেনস্কি। তিনি আরও আর্থিক সাহায্য ও গোলাবারুদ পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
আজভ ব্রিগেডের বেশকিছু সৈন্য রুশ সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ফলে জেনারেল সিরস্কি ভীত হয়ে পড়েন এবং আভদিভকা শহর ছেড়ে দিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন। সেই পিছু হটাই ছিল জেলেনস্কির প্রতিপত্তির জন্য একটি বিরাট ধাক্কা। আভদিভকা শহরের নিয়ন্ত্রণ হারানো এবং আজভ ব্রিগেডের পিছু হটা জেলেনস্কির সরকারের জন্য পদত্যাগ ছাড়া আর কোনও বিকল্প রাখেনি। জেলেনস্কি সেনাবাহিনীতে তার সবচেয়ে উৎসাহী সমর্থকদেরকে হারিয়েছেন। এখন মার্কিন এবং ইউরোপীয় মিত্ররাও হয়তো কিয়েভকে সহায়তা করা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগবে।
ওয়াশিংটন কোনওভাবেই চায়না ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে কোনও চুক্তিতে যাক। ওয়াশিংটন এবং এর মিত্ররা আশা করেছিল তারা ক্রেমলিন থেকে পুতিনকে সরিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু বাইডেনের সেই প্রচেষ্টা সফল হওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়ান অর্থনীতিকে ভেঙে দেওয়ার যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল তাও স্পষ্টত ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন প্রযুক্তি বা পশ্চিমা সাহায্যও ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়নি। সবমিলে এই যুদ্ধ ইউক্রেনের জন্য পরাজয় ছাড়া আর কিছু বয়ে আনেনি।
রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা না করে ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের জন্য ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। আর এই ভুলের খেসারত হল যুদ্ধ। ন্যাটো সম্প্রসারণ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে ইউক্রেনকে মিথ্যা বলা হয়েছিল। এখন সকলেই চাচ্ছে এই যুদ্ধ বন্ধ হোক। যুদ্ধ বন্ধ হলেও ইউক্রেনজুড়ে যে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে তার দায় কে নেবে? ইউক্রেন পুনর্গঠনে যে শত শত বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে সেই অর্থ কে দেবে?
যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে জেলেনস্কির শাসন এখন বিপর্যস্ত। জেলেনস্কির সামরিক আইন বলবৎ থাকার কারণে কোনও নির্বাচন হবে না। কোনও উন্মুক্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়াও হবে না। কিন্তু সেনাবাহিনীতে ক্ষোভ বাড়ছে এবং শিগগিরই বা কয়েক সপ্তাহ পরে সামরিক বাহিনী অন্য কোনও একজন নেতাকে বেছে নেবে। কিয়েভের শাসন পরিবর্তনের ইঙ্গিত এখন আরও স্পষ্ট। সূত্র: এশিয়া টাইমস
বিডি প্রতিদিন/আজাদ