দীর্ঘ ১০ বছর পর ভোটের অধিকার প্রয়োগ করলেন ভারতের জম্মু-কাশ্মীরের মানুষ। রাজ্যটির ৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে বুধবার প্রথম দফায় ২৪ টি আসনে ভোট নেওয়া হয়। এরমধ্যে ৮টি আসন ডোডা, রামবান এবং কিস্তোয়ার- জম্মুর এই তিন জেলায় অবস্থিত। বাকি ১৬টি আসন কাশ্মীরের পুলওয়ামা, সোফিয়া, কুলগাম, অনন্তনাগ- এই চার জেলায় অবস্থিত।
সকাল সাতটা থেকে শুরু হয় ভোট গ্রহণ পর্ব, চলে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ২৪ টি আসনে গড়ে ভোট পড়েছে শতকরা ৫৮.১৯ শতাংশ। জম্মু-কাশ্মীরের প্রধান নির্বাচনি কর্মকর্তা পি.কে পল জানিয়েছেন 'নির্বাচন এখনো পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ। কোনরকম সহিংসতা বা অশান্তির খবর ঘটেনি। ভোট গ্রহণ পর্ব যেভাবে চলছে তাতে ভোট প্রদানের গড় শতকরা হার ৬০ শতাংশ ছড়িয়ে যেতে পারে।'
চলমান এই নির্বাচনে দুই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আব্দুল্লাহর 'ন্যাশনাল কনফারেন্স' ও আরেক সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহেবুবা মুক্তির 'পিপল ডেমোক্রেটিক পার্টি' ছাড়াও দুই জাতীয় রাজনৈতিক দল বিজেপি ও কংগ্রেস নির্বাচনি লড়াইয়ে সামিল হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে আওয়ামী ইত্তেহাদ পার্টি, জামাত-ই-ইসলামী, পিপলস কনফারেন্স, আপনি পার্টি, ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ আজাদ পার্টি- এর মত কয়েকটি ছোট রাজনৈতিক দল। পাশাপাশি বেশ কিছু আসনে স্বতন্ত্র দলের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়াই করছে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা। এই নির্বাচনে জোট গঠন করে লড়ছে ন্যাশনাল কনফারেন্স ও কংগ্রেস।
প্রথম দফায় মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ২৭ হাজার ৫৮০ জন, এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ছিলেন ১১,৭৬,৪৬২ জন, নারী ভোটার ছিলেন ১১,৫১,০৫৮ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ছিলেন মাত্র ৬০ জন। স্বচ্ছ ও অবাধ ভোট গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনের তরফে সব রকম প্রস্তুতি রাখা হয়েছিল। মোট ৩২৭৬ টি ভোটগ্রহণ কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। এর মধ্যে ৩০২ টি কেন্দ্র শহরে এবং গ্রামীণ এলাকায় ছিল ২৯৭৪ ভোটগ্রহণ কেন্দ্র।
এদফায় ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছে ২১৯ জন প্রার্থীর, যার মধ্যে ৯০ জন স্বতন্ত্র দলের হয়ে লড়াই করেছেন। হেভিওয়েট প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন সিপিআইএমের মোহাম্মদ ইউসুফ তারিগামি (কুলগাম), কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক গুলাম আহমেদ মীর (দুরু), ন্যাশনাল কনফারেন্সের সকিনা ইতু (দামহাল হাজিপুরা), পিডিপির ওয়াহিদ-উর-রহমান পারা (পুলওয়ামা), সারতাজ মান্ডি (দেভসোর), ইলতিজা মুফতি (শ্রীগুফওয়ারা-বিজবেহরা), এবং আব্দুল রহমান ভিরি (সাঙ্গুস-অনন্তনাগ)। এছাড়াও ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছে রাজ্যটির সাবেক মন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্স প্রার্থী সাজ্জাদ কিছলু, খালিদ নাজিব সুহারওয়ারদি, কংগ্রেসের বিকার রসুল ওয়ানি, বিজেপির সুনীল শর্মা এবং ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ আজাদ পার্টির আব্দুল মাজিদ ওয়ানি প্রমুখ।
ভোট শুরু হওয়ার আগেই গণতন্ত্রের উৎসবকে শক্ত করতে ফার্স্ট-টাইম ভোটারদের ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদি। নিজের এক্সান্ডেলে মোদি লিখেছেন 'যেহেতু জম্মু-কাশ্মীরের প্রথম দফা বিধানসভার নির্বাচন শুরু হয়েছে, আমি সেইসব কেন্দ্রগুলির ভোটারদের কাছে আহ্বান জানাবো তারা যেন বিশাল সংখ্যায় ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে উপস্থিত থাকেন এবং গণতন্ত্রের উৎসবকে শক্তিশালী করেন। বিশেষ করে যুবসমাজ এবং প্রথম ভোটারদের ভোট প্রদানের আহ্বান জানাবো।'
ঠিক সেভাবেই কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, জম্মু-কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা, জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আব্দুল্লাহ প্রত্যেকেই যুব সমাজ, নারী এবং প্রথম ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু করতে নির্বাচন কমিশনের তরফে যেরকম একাধিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল ঠিক তেমনি কোনরকম অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে প্রশাসনের তরফেয় সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছিল। ভোটাররা যাতে বেশি সংখ্যায় ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হতে পারেন সেই ব্যবস্থা করতে ভোট গ্রহণ কেন্দ্রগুলিতে আটোসাট নিরাপত্তা ব্যবস্থা করেছিল জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন। কেন্দ্রীয় বাহিনীর পাশাপাশি মোতায়েন ছিল জম্মু-কাশ্মীর সশস্ত্র পুলিশ এবং জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য পুলিশ।
সাম্প্রতিককালে জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ঘটনা বৃদ্ধির মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। চলতি বছরে এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী হামলায় জম্মুতে ১৪ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং ১১ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়। আবার সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে ১০ জঙ্গির মৃত্যু ঘটেছে। ঠিক একই সময়ে কাশ্মীরে ৫ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং ৭ জন নাগরিক নিহত হয়েছেন এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জন জঙ্গির। এমন একটা পরিস্থিতিতে নির্বাচন করাটা চ্যালেঞ্জ ছিল সরকার ও প্রশাসনের কাছে।
উল্লেখ্য শেষবার ২০১৪ সালে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল জম্মু-কাশ্মীরে। ওই নির্বাচনে জোট সরকার গঠন করে বিজেপি ও 'পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি' (পিডিপি)। যদিও ২০১৮ সালের ১৮ জুন জোট সরকার থেকে বেরিয়ে আসে মেহেবুবা মুফতির নেতৃতাধীন পিডিপি। সেই সময় থেকে সেখানে কেন্দ্রীয় শাসন চলছে।
এরই মধ্যে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ও ৩৫এ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের পর রাজ্যের মর্যাদা হারায়। সেইসাথে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ নামে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রের মোদী সরকার। সেক্ষেত্রে একদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত অন্যদিকে গত ২০১৪ সালের পর এই প্রথম সেখানে বিধানসভার ভোট হল।
জম্মু-কাশ্মীরের মোট ৯০ আসনের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর ২৬ আসনে এবং তৃতীয় দফায় ১ অক্টোবর ৪০ আসনে ভোট নেওয়া হবে।
ভোট গণনা আগামী ৮ অক্টোবর।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল