কৃষি, ব্যবসা, শিল্প-কারখানা ও চাকরিবাকরি সব কিছুর লক্ষ্য হলো সম্পদ অর্জন করা। বরং এসবের পেছনে মৌলিক উদ্দেশ্য থাকে পৃথিবীতে জীবনধারণের জন্য যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ। এক কথায় সম্পদ অর্জনের উদ্দেশ্য হলো জিন্দেগি বা জীবনযাপন। প্রশ্ন হলো, সৃষ্টির সেরা মানবকুলের জিন্দেগির উদ্দেশ্য কী? ইসলামের দৃষ্টিতে জিন্দেগির উদ্দেশ্য হলো, বন্দেগি তথা স্বীয় রবের গোলামি। তাহলে মানুষের জীবনে খাবারদাবার মূল উদ্দেশ্য নয়; বরং তা একটি প্রয়োজনমাত্র। আর প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্য হলো জিন্দেগি, আর জিন্দেগির মূল উদ্দেশ্য হলো বন্দেগি। বন্দেগি হলো, ইসলামের বিধান সঠিকভাবে পালন করা। এ জন্যই ইসলামের বিধানাবলির পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিপালন খাবারের প্রয়োজন পূরণের ওপর অগ্রাধিকারযোগ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি জিন ও মানুষকে এ জন্যই বানিয়েছি যে তারা আমার ইবাদত করবে।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত : ৫৬)
যখন এটি প্রমাণিত হলো যে ইসলামের বিধান পালন প্রয়োজন পূরণের ওপর অগ্রাধিকারযোগ্য, তাহলে প্রয়োজনাতিরিক্ত ভোগ-উপভোগের ওপর ইসলাম যে অগ্রাধিকারযোগ্য—তা বলাই বাহুল্য। কেননা ভোগ-উপভোগের স্থান তো প্রয়োজন পূরণের পর। প্রয়োজন ও আমোদ-প্রমোদের বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, প্রয়োজনকে সীমিতকরণ এবং আমোদ-প্রমোদকে বাধাহীন ছেড়ে না দিয়ে ইসলামের অনুগামী বানিয়ে নেওয়া। কেননা ইসলামের মূল উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে প্রবৃত্তির চাহিদার গোলামি থেকে মুক্ত করে আল্লাহ তাআলার গোলামিতে নিয়ে আসা। কিন্তু আজকের পৃথিবী মানুষের প্রবৃত্তির চাহিদাকে প্ররোচনা ও উসকানি দিয়ে থাকে; বরং নতুন নতুন চাহিদা খুঁজে বের করে। ফলে মানবজাতি এখন নিজ নিজ চাহিদার অনুসরণ ও ‘বন্দেগি’ শুরু করেছে। এতে প্রবৃত্তির চাহিদা—নাউজুবিল্লাহ—মাবুদের আসন দখল করে বসেছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী) আপনি কি তার অবস্থা দেখেছেন যে স্বীয় নফসের চাহিদাকে নিজের উপাস্য বানিয়ে রেখেছে!’ (সুরা জাসিয়া : আয়াত ২৩)
নফসের চাহিদা থেকে বের হওয়া এ জন্যই জরুরি যে যদি আক্ষরিক অর্থে ইসলামের বিপরীত ও প্রতিপক্ষ কোনো কিছু থাকে তা হচ্ছে নফসের চাহিদা। এ জন্যই কোরআনে কারিমে নফসের পূজাকে আল্লাহর ওহির প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তিনি স্বীয় নফসের চাহিদা থেকে বলেন না, তা তো এমন ওহি যা প্রত্যাদেশ হয়।’ (সুরা নাজম, আয়াত : ৩, ৪)
এই আয়াতে দুটি জিনিসকে পরস্টর প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত করা হয়েছে : এক হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ ওহি। এই ওহিই হলো ইসলাম। দ্বিতীয়টি হলো নফসের চাহিদা। এটি ইসলামের বিপরীত ও প্রতিপক্ষ।
খাবার অন্যতম ইবাদত
খাবার মানুষের প্রাকৃতিক ও মানবিক প্রয়োজন। ইসলামের উদ্দেশ্য এই প্রয়োজনকে বাধা দেওয়া নয়; বরং খাদ্যের প্রয়োজনকে ইবাদতে পরিণত করা। এ জন্যই যে মুসলিম ইসলামী নীতিমালা অনুসারে খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে, সে নিজ প্রয়োজন পূরণ করল, একইসঙ্গে ইবাদতের সওয়াবের অধিকারী হলো। এ জন্যই ইসলাম খাদ্য উপার্জনকে ইবাদত আখ্যা দিয়েছে এবং খাবার গ্রহণকে আবশ্যকীয় করা হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘একজন মুসলিম তার সব কিছুতে সওয়াবের অধিকারী হয়, এমনকি তার মুখে খাবারের যে লোকমা আহরণ করে থাকে তাতেও সে সওয়াব পায়।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৫৩১)
একজন মুসলিম তার সব কিছুতে সওয়াবের অধিকারী হয়, এমনকি তার মুখে খাবারের যে লোকমা আহরণ করে থাকে তাতেও সে সওয়াব পায়- (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৫৩১)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে ব্যক্তি হালাল সম্পদ উপার্জন করবে, অতঃপর তা থেকে নিজেকে কিংবা আল্লাহর অন্য যেকোনো মাখলুককে খাওয়াবে বা পরাবে, এর দ্বারাও সে দানের সাওয়াব পাবে।’ (ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৪২৩৬)
এ জন্যই আবু জার (রা.)-কে যখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল যে ঈমানের পর সর্বোৎকৃষ্ট আমল কোনটি? তিনি বলেন, নামাজ ও রুটি (খাবার) খাওয়া। লোকটি এ কথা শুনে আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইল। আবু জার (রা.)-তাকে বলেন, যদি রুটি (খাবার) না থাকত, তাহলে আল্লাহর ইবাদত সম্ভব হতো না।’ অর্থাৎ রুটি খাওয়ার দ্বারাই পিঠ সোজা রয়েছে, ফলে মানুষ আল্লাহর বন্দেগি যথাযথ পালন করতে পারে। (কিতাবুল কাসব, ইমাম মুহাম্মাদ পৃষ্ঠা ৬২)
এ কারণেই ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞরা লিখেন, কেউ খাবার খেতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তা ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হলে সে মারাত্মক গুনাহগার হবে। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৩৮৯)
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন