ইসলামী সমাজ ও সভ্যতার সূচনা হয় মসজিদ কেন্দ্র করেই। মদিনায় হিজরতের পর মহানবী (সা.) সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মসজিদই ছিল মুসলমানদের সব কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। তিনি মসজিদের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন সুফফা নামক একটি আবাসিক জ্ঞানকেন্দ্র।
মহানবী (সা.)-এর পর সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেঈদের যুগেও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রধান কেন্দ্র ছিল মসজিদ। প্রখ্যাত সাহাবি ও তাবেঈরা বিভিন্ন মসজিদে অবস্থান করে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানপিপাসা নিবারণ করতেন। জ্ঞানচর্চার এই ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থেই মসজিদের সঙ্গে যুক্ত হয় পাঠাগার, যা পরবর্তী যুগে মুসলিম সমাজ ও সভ্যতায় ইসলামী জ্ঞানের প্রসার ঘটাতে অসামান্য অবদান রাখে।
মসজিদভিত্তিক বিখ্যাত পাঠাগার
ইসলামের সোনালি যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের প্রায় সর্বত্র মসজিদভিত্তিক পাঠাগারের দেখা মেলে।
নিম্নে এমন বিখ্যাত কয়েকটি ঐতিহাসিক মসজিদভিত্তিক পাঠাগারের বর্ণনা দেওয়া হলো—
১. কর্ডোভা জামে মসজিদ পাঠাগার : ১৭০ হিজরি মোতাবেক ৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের উমাইয়া শাসক আমির আবদুর রহমান দাখেলি কর্ডোভা জামে মসজিদে পাঠাগার স্থাপন করেন। এই পাঠাগারে তিনি ইসলামী গ্রন্থ এবং কোরআনের বিরল সব অনুলিপির সুবিশাল ভাণ্ডার গড়ে তোলেন। এখানে উসমান (রা.)-এর যুগে তৈরি কোরআনের একটি অনুলিপিও ছিল। ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান বাহিনী কর্ডোভা দখল করার পর ঐতিহাসিক এই পাঠাগার পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়।
২. বায়াজিন মসজিদের পাঠাগার : কৃতী শিল্পী ও হস্তলিপি বিশেষজ্ঞ ইবনে সাকরান স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া শহরের বায়াজিন মসজিদে পাঠাগার গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন গ্রানাডার রাজকীয় পাঠাগারের কর্মকর্তা। এই পাঠাগারের সূচনা হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত বই মসজিদে দান করার মাধ্যমে। স্পেনের মুসলিম মনীষীদের অনেকেই মসজিদ পাঠাগারে তাঁদের ব্যক্তিগত বই দান করেছিলেন। যেমন ইবনে লুব্ব মালাক্কি তাঁর ব্যক্তিগত পাঠাগারে সংরক্ষিত বইয়ের একাংশ গ্রানাডার জামে মসজিদের পাঠাগারে দান করার অসিয়ত করে যান।
ইবনে মারওয়ান আল বাজি তাঁর ব্যক্তিগত সব বই সেভিলের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাঠাগারে দান করে দেন। মুসলিম স্পেনের প্রায় প্রতিটি শহরের প্রধান প্রধান মসজিদে পাঠাগার ছিল।
৩. কারাউইন মসজিদের পাঠাগার : বিশ্বের প্রাচীনতম কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহীয়সী নারী ফাতেমা আল ফিহরি (রহ.)। মরক্কোর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয়েছিল একটি মসজিদ প্রাঙ্গণে, যা এখনো জামে আল কারাউইন নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে এই মসজিদে পাঠাগার স্থাপন করা হয়। সুবিশাল এই পাঠাগারকে তৎকালীন আলেমরা ‘আল খাজানাতুল ইলমিয়্যা’ বা জ্ঞানের ভাণ্ডার বলতেন। সুলতান আবু ইনান মুতাওয়াক্কিলের সহযোগিতায় ৭৫০ হিজরি মোতাবেক ১৩৪৯ হিজরিতে এই পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তী সুলতানরাও পাঠাগারের সমৃদ্ধিতে অবদান রেখেছেন, যা এখনো জ্ঞানান্বেষীদের তৃপ্ত করে যাচ্ছে।
৪. তিতওয়ান মসজিদ পাঠাগার : মরক্কোর তিতওয়ান শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদেও একটি প্রাচীন পাঠাগার রয়েছে। এই পাঠাগারের সূচনা কিভাবে হয়েছিল তা জানা যায় না। স্প্যানিশ বাহিনী সাধারণত কোনো মুসলিম শহর দখল করলে অন্যান্য স্থাপনার সঙ্গে পাঠাগারও ধ্বংস করে দিত। তবে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে স্পেন তিতওয়ান দখল করলেও মসজিদের পাঠাগারটি আশ্চর্যজনকভাবে অক্ষত ছিল।
৫. মাকতাবায়ে ইউসুফিয়্যা : মরক্কোর রাজধানী মারাকেশে অবস্থিত আলী ইবনে ইউসুফে অবস্থিত মাকতাবায়ে ইউসুফিয়্যা। ১১১১ হিজরি মোতাবেক ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইসমাইল উলুভি পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই পাঠাগারের বৈশিষ্ট্য হলো এখানে ধর্মীয় বইয়ের পাশাপাশি ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, গণিত ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নানা শাখার বই বিদ্যমান ছিল।
৬. ইবরাহিম পাশা মসজিদ পাঠাগার : মিসরের সমুদ্রবর্তী শহর ইস্কান্দারিয়ায় অবস্থিত ঐতিহাসিক ইবরাহিম পাশা মসজিদ। এই মসজিদে রয়েছে প্রাচীন পাঠাগার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পাঠাগারের বৃহৎ অংশই ধ্বংস হয়ে যায়।
৭. তানতা মসজিদ পাঠাগার : মিসরের তানতায় অবস্থিত আহমদি মসজিদে রয়েছে শতবর্ষের পুরনো পাঠাগার। ১৩১৬ হিজরি মোতাবেক ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মিসরের আরেকটি প্রাচীন পাঠাগার জামে ইবনে তুলুন মসজিদে অবস্থিত, যা ২৬৫ হিজরিতে সুলতান আহমদ বিন তুলুন প্রতিষ্ঠা করেন।
৮. আল আজহার মসজিদ পাঠাগার : আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণেও রয়েছে প্রাচীন ও বৃহৎ পাঠাগার। যেখানে দুই লক্ষাধিক বই রয়েছে। মিসরের অসংখ্য প্রাচীন মসজিদের সঙ্গেই পাঠাগার ছিল।
শুধু আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং বুখারা, সামারকন্দ, খোরাসানসহ মধ্য এশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলেও মসজিদভিত্তিক পাঠাগারের বিস্তার ঘটেছিল। লেখা দীর্ঘ হওয়ার ভয়ে সে তালিকা এড়িয়ে যাওয়া হলো।
বর্তমান যুগের কয়েকটি মসজিদভিত্তিক পাঠাগার
আধুনিক যুগেও বহু মসজিদে পাঠাগার রয়েছে। পৃথিবীর এমন কয়েকটি পাঠাগারের বর্ণনা দেওয়া হলো—
১. মসজিদুল হারামের পাঠাগার : মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ পাঠাগার মসজিদুল হারামে অবস্থিত। ১৬০ হিজরিতে মসজিদুল হারামে প্রথম পাঠাগার স্থাপন করেন আব্বাসীয় খলিফা আল মাহদি। যুগে যুগে মুসলিম শাসকরা এই পাঠাগারের উন্নয়নে অবদান রেখেছেন। সর্বশেষ বাদশাহ আবদুল আজিজ পাঠাগারটি আধুনিকায়ন করেন। এই পাঠাগারে দুই লাখের বেশি বই, দুর্লভ পাণ্ডুলিপি, পত্র-পত্রিকা ও অডিও রেকর্ডিং রয়েছে।
২. মসজিদে নববীর পাঠাগার : মসজিদে নববীতেও ইসলামের সোনালি যুগে পাঠাগার স্থাপন করা হয়। কিন্তু ৮৮৬ হিজরি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় তা ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ মদিনায় পাঠাগার স্থাপন করেন। এই পাঠাগারে এক লাখ ৭২ হাজারের বেশি বই রয়েছে।
৩. মসজিদুল আকসার পাঠাগার : আইয়ুবীয় শাসকদের আমলে মসজিদুল আকসায় বই-পুস্তকের বিশেষ ভাণ্ডার গড়ে তোলা হয়। তবে তা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পাঠাগার ছিল না। জনসাধারণও তা থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ পেত না। ১৯২২ সালে বই-ভাণ্ডারের বই এবং নতুনভাবে কিছু বই সংযুক্ত করে পাঠাগার গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। প্রায় ৫০ বছরের প্রচেষ্টা তা পূর্ণাঙ্গ পাঠাগারে রূপ নেয় এবং ১৯৭৬ সালে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এখানে দুষ্পাপ্য বহু বই ও পাণ্ডুলিপি রয়েছে। এই পাঠাগারকে ‘খাজানাতুল ইলম’ বা জ্ঞানের ভাণ্ডার বলা হয়।
৪. সানআর কেন্দ্রীয় মসজিদের পাঠাগার : ইয়েমেনের রাজধানী সানআর প্রধান মসজিদ ‘জামে আল কাবির’। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশে এই মসজিদের গোড়াপত্তন হয়েছিল। উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক এখানে বড় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদেই রয়েছে ইয়েমেনের সর্ববৃহৎ পাঠাগার। পাঠাগারটি ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে প্রতিষ্ঠিত।
৫. বায়তুল মোকাররম পাঠাগার : জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের প্রাঙ্গণেই অবস্থিত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী পাঠাগার। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে এই পাঠাগারের যাত্রা শুরু হয়। বাংলা, আরবি, উর্দু, ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় রচিত প্রায় ৫০ হাজার বই ও ম্যাগাজিন এখানে সংরক্ষিত আছে। দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ কোরআনের অনুলিপি এখানে সংরক্ষিত আছে।
তথ্যঋণ : (বই) মাকতাবাতুল মাসাজিদ, আলুকা ডটকম, আলজাজিরা, আরব নিউজ ও উইকিপিডিয়া
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন