ইসলামের শুরু যুগে ইসলাম গ্রহণকারী ত্যাগী সাহাবি সালিম (রা.)। ইরানি বংশোদ্ভূত এই সাহাবির উপনাম ছিল আবু আব্দুল্লাহ। পিতার নাম উবাইদ ইবনে রাবিআহ মতান্তরে মাক্বিল। পারস্যের ‘ইসতাখার’ অঞ্চলে তাঁর পিতৃপুরুষের আবাসভূমি ছিল বলে জানা যায়। তবে আবু হুযাইফা (রা.)-এর আজাদকৃত দাস হিসেবেই প্রসিদ্ধ ছিলেন।
তিনি একসময় সুবাইতা আল-আনসারিয়া (রা.)-এর দাস হিসেবে মদিনায় আসেন। সুবাইতা ছিলেন আবু হুযাইফা (রা.)-এর স্ত্রী। সুবাইতা দাস সালিমকে আজাদ করে দিলে আবু হুযাইফা (রা.) তাঁকে ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেন।
এর পর থেকে তিনি ‘সালিম ইবনে আবু হুযাইফা’ হিসেবে পরিচিত হয়ে যান। অবশ্য পরে ইসলাম পালকপুত্র-প্রথা বাতিল করার পর তিনি ‘মাওলা আবী হুযাইফা’ (আবু হুযাইফার আজাদকৃত দাস) হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। কেউ কেউ তাঁকে আবু হুযাইফা (রা.)-এর দাস হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। এসব কারণে তাঁকে মুহাজিরদের মধ্যে গণ্য করা হয়।
অন্যদিকে সুবাইতা (রা.)-এর আজাদকৃত দাস হওয়ার কারণে তাঁকে আনসারিও বলা হয়। আবার বংশমূলের দিক থেকে পারস্যের সন্তান হেতু তাঁকে আজমি বা অনারবিও বলা হয়। (উসদুল গাবাহ : ২/১৫৫পৃ., ক্র.১৮৯৪; আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ৩/৬৩ পৃ., ক্র.১৬)
সালিম মক্কায় আবু হুযাইফা (রা.)-এর সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন। আবু হুযাইফা (রা.) স্বীয় ভাতিজি ফাতিমা বিনতে ওয়ালিদ ইবনে উতবাকে তাঁর কাছে বিয়ে দেন। (বুখারি : ২/৫৭০ পৃ.; আবুদাউদ ১/২৮১ পৃ.; উসদুল গাবাহ্ ২/১৫৬ পৃ., ক্র.১৮৯৪)
ইসলাম গ্রহণ ও মদিনায় হিজরত
সালিম (রা.) স্বীয় অভিভাবক আবু হুযাইফা (রা.)-এর সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলামের সূচনালগ্নে যাঁরা রাসুল (সা.)-এর ডাকে সাড়া দিয়ে মুসলমান হয়েছেন, তাঁদের অন্যতম হলেন আবু হুযাইফা (রা.) ও তাঁর পালকপুত্র সালিম (রা.)। ইসলাম গ্রহণের পর নিষ্ঠুর কাফিরদের অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন সয়েছেন পিতা-পুত্র দুজন। অবশেষে দ্বিন ও ঈমান রক্ষার মহান স্বার্থে মদিনায় হিজরত করেন রাসুল (সা.)-এর হিজরতের পূর্বেই। (উসদুল গাবাহ : ২/১৫৫পৃ.)
দাসত্ব থেকে মর্যাদার মসনদে
সালিম (রা.) ছিলেন একজন সাধারণ দাস। তাঁর জীবনকাহিনি বিলাল হাবশি (রা.)সহ অন্যান্য অসহায় দাসের মতো, যাঁরা দাসত্বের জিঞ্জিরে আবদ্ধ অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করেন। সর্বশেষ ইসলাম তাদেরকে দাসত্বের জিঞ্জির থেকে মুক্ত করে সমাসীন করেছে মর্যাদা ও নেতৃত্বের আসনে। তাঁর ব্যাপারে হজরত উমার (রা.) একটি উক্তিই তাঁর ইলমি দক্ষতা ও মর্যাদা পরিমাপের জন্য যথেষ্ট। উমার (রা.) অন্তিম সময়ে পরবর্তী খলিফা নির্বাচন প্রসঙ্গে কমিটি গঠনকালে বলেছিলেন, ‘আজ যদি সালিম জীবিত থাকত, কোনো কমিটি গঠন ছাড়াই আমি খেলাফতের দায়িত্ব তার হাতে তুলে দিতাম’। (উসদুল গাবাহ : ২/১৫৬পৃ.)
কিরাত ও সুমধুর তিলাওয়াত
সালিম (রা.) ইলমুল কিরাত (বিশুদ্ধ কোরআন পাঠ-বিদ্যা)-এ ছিলেন যেমন দক্ষ, তেমন তিলাওয়াতেও ছিলেন সুমধুর কণ্ঠস্বর। তাঁর সুমধুর কণ্ঠের তিলাওয়াতে মুগ্ধ ছিলেন খোদ রাসুল (সা.) ও উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.)। তিনি অন্যকেও উদ্বুদ্ধ করেছেন তাঁর থেকে কোরআন শিখতে। ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা কোরআন শিখো চার ব্যক্তি―আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, সালিম মাওলা আবু হুযাইফা, উবাই ইবনে কা’ব ও মু‘আজ ইবনে জাবাল থেকে’। এ কারণে সালিমকে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে অধিক সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী মনে করা হতো এবং সেভাবে তিনি মূল্যায়িতও ছিলেন। রাসুল (সা.)-এর হিজরতের পূর্বে মসজিদে কুবার ইমামতি করতেন সালেম (রা.)। প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফা আবু বকর (রা.) ও উমার (রা.)-এর মতো বিশিষ্ট সাহাবিও তাঁর পেছনে মুক্তাদি হয়ে নামাজ আদায় করেছেন। (আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ৩/৬৪পৃ.)
যুদ্ধ-জিহাদে অংশগ্রহণ ও শাহাদাতবরণ
বদর, উহুদ, খন্দকসহ সব যুদ্ধেই তিনি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন। আবু বকর (রা.)-এর খেলাফতের প্রথম দিকেই মাথাচাড়া ওঠে মুরতাদ-ফিতনা, যার মোকাবেলা করতে গিয়ে ১২ হিজরি সনে সংঘটিত ভয়াবহ ইয়ামামার যুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেন। (উসদুল গাবাহ : ২/১৫৬পৃ., ক্র.১৮৯৪; আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ৩/৬৫ পৃ.)
সে যুদ্ধে তাঁর ইসলাম গ্রহণকারী সঙ্গী আবু হুযাইফা (রা.)ও শহীদ হন। তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছেন একসঙ্গে, হিজরতও করেছেন একসঙ্গে, সর্বশেষ শাহাদাতবরণও করেছেন একসঙ্গে এবং চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন এক স্থানে।