ইসলাম শুধু বাহ্যিক আমল বা আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়, ইসলাম বান্দার নিষ্ঠা ও ভালোবাসারও নাম। ইসলামের বাহ্যিক দিক রয়েছে, তেমনি আছে অভ্যন্তরীণ দিক। যাকে বলে অন্তরের আমল। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের বাহ্যিক আমল নির্ভর করে তাঁর অন্তরের আমলের ওপর।
এ জন্য নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই নিয়তের ওপর যাবতীয় আমলের ফলাফল নির্ভরশীল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১)
নিম্নে মুমিন বান্দার অন্তরের আমলগুলো তুলে ধরা হলো—
বিশ্বাসী অন্তরের আমল
মুমিন বান্দার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি অন্তরের আমল তুলে ধরা হলো—
১. ইখলাস বা নিষ্ঠা : ঈমানের পর মুমিন অন্তরের প্রধান আমল হলো ইখলাস বা নিষ্ঠা। নিষ্ঠা হলো কোনো কাজ শুধু আল্লাহর জন্য করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির সামনে পৃথিবীর কাউকে ভ্রুক্ষেপ না করা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং নামাজ কায়েম করতে ও জাকাত দিতে, এটাই সঠিক দ্বিন।’ (সুরা : বাইয়িনাহ, আয়াত : ৫)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘বলো, আমার নামাজ, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগত্গুলোর প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশ্যে। তাঁর কোনো শরিক নেই এবং আমি তাঁরই জন্য আদিষ্ট হয়েছি। আর আমিই প্রথম মুসলিম।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৬২-১৬৩)
২. তাওয়াক্কুল : তাওয়াক্কুল হলো যেকোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখা।
তাওয়াক্কুল ঈমানের দাবি ও মুমিনের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তুমি বোলো, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। আমি তাঁরই ওপর নির্ভর করি এবং তিনি মহা আরশের অধিপতি।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১২৯)
৩. রজা বা আশাবাদ : রজা হলো সব সময় আল্লাহর কাছ থেকে ভালো প্রত্যাশা করা, নিরাশ না হওয়া। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর আশিস থেকে নিরাশ হয়ো না।
কেননা আল্লাহর আশিস থেকে শুধু অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ই নিরাশ হয়ে থাকে।’
(সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৮৭)
৪. খওফ বা ভয় : খওফ হলো অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত রাখা। আল্লামা ইবনে কুদামা (রহ.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই ভয় হলো আল্লাহর চাবুক, যার মাধ্যমে তিনি তাঁর বান্দাদের ইলম ও আমলের পথে পরিচালিত করেন। যেন তারা ইলম ও আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে। আল্লাহভীতি হলো অন্তরের সেই প্রদীপ, যার মাধ্যমে ভালো ও মন্দ প্রত্যক্ষ করা যায়।’ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর বান্দাদের ভেতর যারা জ্ঞানী তারাই তাঁকে ভয় করে।’ (সুরা : ফাতির, আয়াত : ২৮)
৫. শোকর : শোকর হলো আল্লাহর অনুগ্রহগুলো অন্তরে স্মরণ রেখে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের শোকর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদের অবশ্যই অধিক দেব আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৭)
৬. রিদা বা সন্তুষ্টি : রিদা বা সন্তুষ্টির দুটি দিক। এক. আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও নির্ধারণের ওপর বান্দার সন্তুষ্টি, দুই. নিজের আমলের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা। দুটিই অন্তরের আমলের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের ভেতর এমন লোকও আছে, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আত্ম-উৎসর্গ করে থাকে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ার্দ্র।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২০৭)
৭. সবর বা ধৈর্য : বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। বিপদে মুমিন আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকবে এবং আল্লাহর কাছে প্রতিদান আশা করবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, ধৈর্যে প্রতিযোগিতা করো এবং সদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো, আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ২০০)
৮. মুহাসাবা বা আত্মজিজ্ঞাসা : ইসলাম মানুষকে মুহাসাবা বা আত্মজিজ্ঞাসায় উদ্বুদ্ধ করে। কেননা আত্মজিজ্ঞাসা মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং আত্মশুদ্ধির সুযোগ তৈরি করে দেয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যেদিন প্রত্যেকে সে যে ভালো কাজ করেছে এবং সে যে মন্দ কাজ করেছে তা বিদ্যমান পাবে, সেদিন সে তার ও তার কৃতকর্মের ভেতর দূর ব্যবধান কামনা করবে। আল্লাহ তাঁর নিজের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করছেন। আল্লাহ বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ার্দ্র।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৩০)
৯. তাফাক্কুর : তাফাক্কুর হলো আল্লাহর বড়ত্ব ও মাহাত্ম্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করার মাধ্যমে আল্লাহর পরিচয় লাভ করা। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে তাফাক্কুরের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহর স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে ও বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এটা নিরর্থক সৃষ্টি করোনি, তুমি পবিত্র, তুমি আমাদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা কোরো।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯১)
১০. মহব্বত : আল্লাহকে ভালোবাসা এবং আল্লাহর ভালোবাসাকে মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করে তার আলোকে অন্যদের ভালোবাসা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ ছাড়া অপরকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভালোবাসার মতো তাদেরকে ভালোবাসে; কিন্তু যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসায় তারা সুদৃঢ়।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৬৫)
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন