রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা

অধিক জমি গ্রহণে রেলওয়ের লাল দাগ উদ্বিগ্ন এলাকাবাসী

ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে গঙ্গাসাগর হয়ে মুগড়া-মনিঅন্ধ দিয়ে রেলওয়ে লাইন সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে এলাকাবাসী। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই লাল দাগ দিয়ে জমি অধিগ্রহণ করতে ওই এলাকা চিহ্নিত করে। উচ্ছেদের লাল আতঙ্কে উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা এখন প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছেন। বিক্ষুব্ধ জনতা এলাকায় ইতোমধ্যেই এর প্রতিবাদে সভা, সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। এতে অংশ নেন উপজেলার কয়েকটি গ্রামের অধিবাসী, দুটি বাজার ও প্রায় ৯০০ বছরের পুরনো একটি মন্দিরের পরিচালনা কমিটি। তারা আখাউড়া-আগরতলা রেললাইন স্থাপন ও লাকসাম পর্যন্ত ডাবল রেললাইন নির্মাণে অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।

এলাকাবাসীর মতে, ব্রিটিশ আমলে অধিগ্রহণ করা জমিতেই এই সম্প্রসারণ সম্ভব। এ প্রসঙ্গে তারা ইউএনও এবং রেলের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এবং রেলমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও প্রদান করেছেন। ব্রিটিশ আমলে অধিগ্রহণকৃত পর্যাপ্ত জমি ও রেললাইনের পাশে খালি জায়গা পড়ে থাকা সত্ত্বেও বসতভিটা উচ্ছেদ করে নতুন লাইন নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তারা। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, সম্প্রতি আখাউড়া-আগরতলা রেল ট্রানজিট রুট নির্মাণের লক্ষ্যে রেলওয়ের জরিপ দল মোগড়াবাজার, দরুইন, নয়াদিল, দেবগ্রাম, মনিঅন্ধ ও আখাউড়া শহরের শতাধিক বাড়িঘর ও দোকানপাটে লাল দাগ ও নম্বর বসিয়ে দিয়েছেন। রেলওয়ের এই অযৌক্তিক অধিগ্রহণ তৎপরতা বন্ধের দাবি জানিয়ে মোগড়াবাজার ও আখাউড়া এলাকাবাসী এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। মোগড়াবাজার ও আখাউড়ায় মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। এলাকাবাসীর বক্তব্য, তারা আগরতলা রেল ট্রানজিটকে স্বাগত জানাবেন। তবে তা জনসাধারণের শত বছরের পুরানো বসতবাড়ি, মার্কেট, মন্দির, মসজিদ ভেঙে নয়। ব্রিটিশ আমলে রেলের জন্য সরকার প্রচুর জমি অধিগ্রহণ করে গেছে। প্রযুক্তিগত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে খালি জায়গা দিয়ে নতুন রেললাইন নির্মাণের দাবি তুলেছেন তারা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রেল এই পরিকল্পনা নিয়ে অগসর হলে আখাউড়া থেকে গঙ্গাসাগর হয়ে সীমান্ত এলাকার ইটনা-মিনারকুট পর্যন্ত কমপক্ষে দশ কি.মি. একালাজুড়ে বিশ সহস্রাধিক মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমি অধিগ্রহণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রেলের জন্ম আজ থেকে ১৫১ বছর আগে। ব্রিটিশ আমলে ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর। তখনকার আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের লোকসংখ্যা আড়াই কোটির বেশি ছিল না। প্রচুর খালি জায়গা ছিল। ব্রিটিশ সরকার ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণ চিন্তা মাথায় রেখেই রেলের জন্য পর্যাপ্ত জমি অধিগ্রহণ করে গেছে। বর্তমানে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। ১৮৬২ সালের তুলনায় অন্তত সাত গুণ বেশি। ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে রেল কর্তৃপক্ষ তাই ব্রিটিশ স্টাইলে জমি অধিগ্রহণে নামতে পারে কিনা এই প্রশ্ন এলাকাবাসীর।

এলাকাবাসীর প্রশ্ন, ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল লাইন যেখানে নির্মিত হতে যাচ্ছে সেখানে আগরতলা রেল ট্রানজিটের জন্য আরও একটি লাইন অর্থাৎ আখাউড়া থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত তিনটি রেললাইন নির্মাণ ঘনবসতির দেশে কতটা যুক্তিসঙ্গত? এ ব্যাপারে স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কোনো মতামত নেওয়া হচ্ছে না কেন? দেশের প্রচলিত আইনে সরকারি ভূমি অধিগ্রহণ থেকে উপাসনালয়কে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, সরকার কোনো মন্দির, মসজিদ বা কবরস্থান অধিগ্রহণ করবে না। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ মোগড়াবাজারে ৯০০ বছরের প্রাচীন দশভূজা কালিমন্দিরে লাল দাগ ও নম্বর বসিয়ে দিয়েছে। উদ্দেশ্য মন্দিরটি ভেঙে রেল ট্রানজিট নির্মাণ। বিয়ষটি কেবল আখাউড়া নয়, সারা দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সেন্টিমেন্টকে আঘাত করেছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংখ্যালঘু নেতারা। রেলওয়ের এই তৎপরতার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা রতন পাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, রেলের জন্মের আগে প্রতিষ্ঠিত এই কালি মন্দির। ব্রিটিশ সরকারও মন্দিরটি ভাঙেনি। রেললাইন নিয়ে গেছে পাশ দিয়ে। অথচ বাংলাদেশ রেলওয়ে পরিণাম বিবেচনা না করেই মন্দিরের গায়ে লাল দাগ মেরে দিয়েছে।

মন্দির কমিটি জানিয়েছেন, মোগড়াবাজারের দশভূজা কালিমন্দির হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি তীর্থস্থান। এলাকার মুসলমান নেতারাও এই মন্দিরের উচ্ছেদ প্রচেষ্টার ঘোর বিরোধী। এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের আশঙ্কা রয়েছে। এলাকার সর্বস্তরের নেতারা বলেছেন, মন্দিরের ক্ষতি হলে দায়-দায়িত্ব রেল কর্তৃপক্ষকেই বহন করতে হবে।

জানা গেছে, রেল কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনা গোপন রাখলেও উত্তর মনিঅন্ধ, গাঙ্গাইল, বড় গাঙ্গাইল, বানরসার, তুলাইশিমুল, বড় লোঘর, মিনারকুট ও ইটনা এবং আশপাশের গ্রামের মানুষের জমি ও বাড়িঘর অধিগ্রহণের আওতায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ আগরতলা থেকে রেললাইনটি বেলাবর-গজারিয়া হয়ে বাংলাদেশে ঢুকবে। মোগড়া-মনিঅন্ধ ইউনিয়নের সীমান্তের মানুষ তাই এ প্রশ্নও তুলছেন কসবা ও আজমপুর সহ আরও দুটি পয়েন্টে রেলপথ যেখানে ত্রিপুরা সীমান্ত ঘেঁষে বয়ে গেছে সেখানে রেল ট্রানজিট দিলেই বাংলাদেশের জনগনের এত জমি নষ্ট হবে না।

সর্বশেষ খবর