বুধবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ভালো নেই যশোরের ‘ঈশ্বরের সন্তান’রা

সাইফুল ইসলাম, যশোর

৯ ফুট বাই ১২ ফুটের ছোট্ট একটি জরাজীর্ণ ঘরে তিন ভাইয়ের বসবাস। বাবু, ছাবু ও সাগর হরিজন। বাবু আর ছাবু হরিজন বিবাহিত। স্ত্রীদের নিয়ে থাকেন ওই একই ঘরে। ছোট ভাই সাগরের বয়স ১৫ বছর। বিয়ে করেননি। তিনিও ওই একই ঘরে থাকেন। কিন্তু কীভাবে সম্ভব! বাবু হরিজন বললেন, ‘এক পরিবার খাটের ওপর, আরেক পরিবার নিচে, আর  ঘরের সঙ্গে নামকাওয়াস্তে যে বারান্দা, সেখানে ঘুমায় সাগর। মান-ইজ্জত নিয়ে এভাবে বেঁচে থাকা যায় না।’ একই আয়তনের পাশের ঘরে স্ত্রী রিনা হরিজনকে নিয়ে বসবাস করেন সাধু হরিজন। ওই একই ঘরে থাকে তার তিন মেয়ে ১৬ বছরের অঞ্জলি, ১২ বছরের প্রীতি ও ৬ বছরের ইতি এবং ৫ বছরের ছেলে আনন্দ। সবার বড় মেয়ে জ্যোতির বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর পাশের ঘরও একই আয়তনের। গোলাপচান হরিজন তার পরিবারের সাত সদস্যকে নিয়ে বাস করেন সেখানে।

যশোর পুরাতন পৌরসভা হরিজন পল্লীতে যে ৩৪টি পরিবার বসবাস করে, তাদের সবার অবস্থা মোটামুটি একই রকম। যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্রে পৌরসভার মাত্র সাড়ে ১৯ শতক জায়গায় এ ৩৪টি পরিবারের ১৪৫ সদস্য গাদাগাদি করে বসবাস করছেন। শহর ও আশপাশে রয়েছে এ রকম আরও পাঁচটি হরিজন পল্লী। সেখানে একইভাবে বসবাস করছে আরও ৩৮১টি পরিবার। সমাজের মূল স্রোতে মিশিয়ে দিতে গান্ধী এদের নাম দিয়েছিলেন হরিজন (হরির জন) বা ‘ঈশ্বরের সন্তান’। কিন্তু আজও কি মিশতে পেরেছেন তারা সমাজে? সরেজমিন যশোর পুরাতন পৌরসভা হরিজন পল্লীতে গিয়ে দেখা যায় মাত্র সাড়ে ১৯ শতক জায়গায় ২৩ পরিবারের বসবাসের করুণ চিত্র। চারপাশ দিয়ে বেড়ে ওঠা সুরম্য অট্টালিকাগুলো এদের জরাজীর্ণ ঘরগুলোকে যেন চেপে ধরেছে। শীতকালটা যেমন-তেমন, বর্ষা শুরু হলেই চরম বিপদ। ১৪৫ জনের জন্য মাত্র তিনটি বাথরুম। তাও আবার বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা নেই। রাতে বাথরুমে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় তাদের। সকালে পুরুষ সদস্যদের দৌড়াতে হয় শহরের পাবলিক টয়লেটগুলোতে। দিনরাত খাটাখাটনি করে শহর পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব যাদের, সেই তারাই শহরে বসবাস করেও শহরবাসীর কাছ থেকে যেন যোজন-যোজন দূরে। পুরনো পৌরসভা হরিজন পল্লী উন্নয়ন কমিটির সভাপতি সার্জন হরিজন বলেন, ‘কদিন আগে এখানকার পরিস্থিতি আরও খারাপ ছিল। বর্ষায় হাঁটু পর্যন্ত কাদা জমত। নোংরা গন্ধে বাইরের লোক ঢুকতে পারত না। মাত্র একটি ভাঙাচোরা বাথরুম ছিল। সম্প্রতি যশোর পৌরসভা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ধারা ও প্রাকটিক্যাল অ্যাকশন যৌথ উদ্যোগ নিয়ে তাদের তিনটি পাকা বাথরুম, পাকা ড্রেন এবং উঠানটিও পাকা করে দিয়েছে। এর ফলে এখানকার পরিবেশ আগের চেয়ে কিছুটা ভালো।’ একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুফিয়া হরিজন বলেন, ‘আমরা এখনো ভদ্র এলাকায় জমি কিনতে পারি না। ভদ্রলোকের সঙ্গে মিশতে পারি না। আমাদের মদ খেতে হয়, শূকর খেতে হয়। তাই আমাদের কেউ পাশে রাখতে চায় না। আমাদের এখানেই থাকতে হবে। তাই এ জায়গাতেই আমাদের জীবনযাত্রার মান আরেকটু উন্নত করতে পারলে ভালো হতো।’ এই কমিটির সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ সম্পাদক চঞ্চল হরিজন বলেন, ‘১৪৫ সদস্যের জন্য তিনটি বাথরুম খুবই কম। আরও তিনটি হলে ভালো হয়। বাথরুমে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বাসস্থানের। দেখলেন তো, ছোট্ট একটি ঘরে কীভাবে তিন ভাই স্ত্রীদের নিয়ে একসঙ্গে বসবাস করছেন! আমরা মানসম্মান রাখতে পারছি না।’ যশোর পৌরসভার বর্তমান মেয়রের প্রশংসা করে সন্ধ্যা রানী হরিজন বললেন, ‘এ রকম মেয়র জীবনে পাইনি। আমাদের সম্মান করেছেন। আমাদের যে কোনো সমস্যা মেয়র নিজ থেকে সমাধান করেছেন। পৌরসভার বাজেট করতে গিয়েও আমাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছেন তিনি। আমাদের সঙ্গে মিলে খেয়েছেন।’ সন্ধ্যা রানী বলেন, ‘মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফোরামের মাধ্যমে একবার আমাদের আবাসনের জন্য বিল্ডিং করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে সেটি কী কারণে বন্ধ হয়ে গেছে জানি না।’ যশোর পৌরসভার মেয়র মারুফুল ইসলাম বলেন, ‘যশোরের তিনটি হরিজন পল্লীতে এডিবির সহায়তায় পাকা বিল্ডিং করে দেওয়ার জন্য ৩০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হরিজন নেতাদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত হাতছাড়া হয়ে গেছে। এর পরও পৌরসভার পক্ষ থেকে তাদের (হরিজনদের) আবাসন ব্যবস্থার উন্নয়নসহ সব সমস্যা সমাধানে আমরা সব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন বাংলাদেশের সমন্বয়ক আতাহার আলী বলেন, ‘যশোর পৌরসভা ও এনজিও ধারার সহযোগিতায় প্রথমে আমরা এখানকার হরিজন পল্লীগুলোর সমস্যা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। সে অনুযায়ী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিনটি বাথরুম এবং ড্রেন ও উঠান পাকা করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর