বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

লক্কড়ঝক্কড় পরিবহনে সীমাহীন দুর্ভোগ

আনফিট গাড়িতে সয়লাব রাজধানী, অনেক গাড়ির বয়স ৩০ ছুঁই ছুঁই

সাঈদুর রহমান রিমন

লক্কড়ঝক্কড় পরিবহনে সীমাহীন দুর্ভোগ

গড় গড় ভয়ানক শব্দ তুলে ইঞ্জিন। নিকষ কালো মেঘের মতো অনর্গল ধোঁয়া নির্গমন হয়। দরজা-জানালা ভাঙা, স্থানে স্থানে ছোট-বড় ফোকলা। এসব নিয়েই ঝনঝন করে ছুটে চলা মুড়ির টিন-মার্কা পরিবহনের যন্ত্রণা থেকে কোনোভাবেই রেহাই মিলছে না। রাস্তায় বের হলেই চোখে পড়ে লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন। বাসের বডির অংশ খুলে পড়েছে। কোনোটার সামনের বিরাট অংশই ভাঙা। পেছনের বাম্পার খুলে ঝুলে আছে। জানালা বলতে কিছু নেই। ভিতরে বসার সিটগুলো নড়বড়ে। জোড়াতালি দিতে দিতে সিটকভারের ওপর দুর্ভিক্ষের ছাপ পড়ে গেছে। কোনোটির রংচটা, কোনোটির ছাল ওঠা। কিছু বাসের বাইরের রং ঠিক থাকলেও ভিতরের অবস্থা করুণ। ছাদ দিয়ে পানি পড়াসহ বিভিন্ন ধরনের ত্রুটিযুক্ত গণপরিবহনে সয়লাব রাজধানী। হর্ন, ওয়াইপার ও ফিটনেস ভালো না থাকলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণপরিবহনে যাত্রীরা চলাচল করছে স্বদর্পে। মালিকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে নির্বিঘ্নে চলাচল করছে পরিবহনগুলো। প্রতিদিনই দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে লক্কড়ঝক্কড় মার্কার শত শত বাস, মিনিবাস, লেগুনা চলছে, সেগুলোতেই প্রাণ হাতে নিয়ে যাতায়াত করছেন যাত্রীরা। উন্নত সেবা দেওয়ার নামে বিভিন্ন সময় রাজধানীতে নানা কোম্পানির ব্যানারে যেসব গাড়ি নামানো হয়েছে সেগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়। বর্তমানে রাজধানীতে ৯২টি কোম্পানির প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাস চলছে। চলমান বেশির ভাগ বাসেরই ফিটনেস নেই। দরজা-জানালা ভাঙা, বসার সিট ছেঁড়া ও সামান্য বৃষ্টিতেই বাসের ভিতর পানি পড়ে। এতে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কোনোভাবে বাস মিললেও এতে সিট তো দূরের কথা, থাকে না পা রাখার জায়গাটুকু। 

ঢাকা-গাজীপুর রুটে চলাচলকারী যানবাহনের অবস্থা আরও খারাপ। ওই রুটে বলাকা, তুরাগ, ছালছাবিল, অনাবিল, সুপ্রভাতসহ ১১টি কোম্পানির আওতায় ১২ শতাধিক বাস-মিনিবাস চলাচল করলেও মাত্র ৪৭টি গাড়ির রুট পারমিট, ফিটনেস ও অন্যান্য কাগজপত্রাদি যথারীতি সঠিক রয়েছে, বাকি সব গাড়িই চলছে ট্রাফিক বিভাগকে ম্যানেজ করে। একইভাবে মিরপুর-পল্লবী থেকে গুলশান-বাড্ডা রুটে চলাচলকারী ছয়টি কোম্পানির চার শতাধিক গাড়ি চলাচল করলেও রুট পারমিট ছাড়াই চলছে আকিক পরিবহন। এ পরিবহনের শতাধিক মিনিবাস মিরপুর-নতুনবাজার-বেরাইদ রুটের পারমিট নিলেও তারা অবৈধভাবে বাড্ডা রুটেই যাতায়াত করছে।

গাবতলী-সায়েদাবাদ রুটের ৮ নম্বর মিনিবাস, মোহাম্মদপুরের মেশকাত পরিবহন, ইউনাইটেড পরিবহন, মতিঝিল-গাজীপুরের গাজীপুর পরিবহন, তানজিল পরিবহন, মিরপুর সার্ভিস, ইটিসি ট্রান্সপোর্ট, এটিসিএল, তরঙ্গ পরিবহন, মিডওয়ে, আজিমপুরের ভিআইপি পরিবহন, মিরপুর চিড়িয়াখানা রুটের নিউভিশন, যাত্রাবাড়ী টঙ্গীর তুরাগ পরিবহন, ছালছাবিল পরিবহন, অনাবিল পরিবহনসহ আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানির অধিকাংশ বাসে ঝুঁকি নিয়ে চলেন যাত্রীরা। এগুলোর বয়স ১৫-২০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। তবুও দিব্যি চলছে সেসব গাড়ি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, গত ১০ বছরে ১৬৭টি রুটে সাড়ে পাঁচ হাজার বাস-মিনিবাস চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে এসব রুটে গাড়ি চলাচলের বিষয় তদারকি পর্যন্ত করা যাচ্ছে না। পরিবহন মালিক সমিতির হিসাব মতে, ঢাকায় ১৯৩টি রুটে চলাচলকারী যানবাহনের মধ্যে সহস াধিক বাস-মিনিবাস ১৫-২০ বছরের পুরনো। কোনো কোনোটির বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। সেগুলোও ফিটনেস সার্টিফিকেট ও রুট পারমিট ছাড়াই বিভিন্ন রুটে দিব্যি যাত্রী বহন করে চলেছে। ঢাকার গণপরিবহন খাতে ব্যাপক অসঙ্গতি ও অনিয়ম দূর করা এবং ব্যবহার অযোগ্য বাসের চলাচল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে বহুবার। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, ব্যবসায়ী, ট্রেড ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মহলের বাধায় সেসব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। ঢাকার রাস্তায় চলাচলরত বেশির ভাগ বাসই ২০ বছরের পুরনো। এসব বাসের মধ্যে বেশির ভাগই মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। তার ওপর বাস, মিনিবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বেশির ভাগ যানবাহনের চালকের নেই বৈধ লাইসেন্স।

বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, গত ১০ বছরেও ফিটনেস নেয়নি এসব গাড়ির লাইসেন্স ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। এমন গাড়ির সংখ্যা ছয় লাখের ওপরে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি ধরতে রাজধানীর সড়কগুলোতে প্রায়ই বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছে।  সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত বছর ঘোষণা দিয়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযানে নামেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার আগের অবস্থায় চলে যায়। তবে রাস্তায় চলাচলকারী আনফিট গাড়ি তুলে নেওয়ার জন্য পুনরায় মে মাস থেকে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেন, আর কিছুদিন পর ঢাকা উত্তর সিটিতে পুরনো গাড়ি থাকবে না। মাত্র ৫টি কোম্পানিতে এনে বাস চলাচলের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একই রুটে আলাদা কোম্পানির কোনো গাড়ি থাকবে না। এর জন্য এখন পলিসি নির্ধারণ চলছে। নতুন গাড়িগুলো নামিয়ে পর্যায়ক্রমে পুরনোগুলো ওঠানো হবে।

সর্বশেষ খবর