রবিবার, ১২ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাচার হওয়া এক নারীর আর্তনাদে ভারি হলরুম

অপরাধীদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাইলেন র‌্যাব ডিজি

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘আমাকে একটা পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়। সেখানে তিন মাস আটকে রেখে চলে অমানুষিক নির্যাতন। বাধা দিলে শরীরে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো। অসুস্থ হয়ে পড়তাম। এরপরও নিস্তার পেতাম না। দিনে-রাতে নানা উপায়ে নির্যাতন চলত। একদিন বাড়িতে ফোন করে মাকে সব বলি। এরপর র‌্যাবের সহায়তায় দেশে ফিরে আসি। আমার মতো আর কোনো নারীকে যেন এভাবে আর অসম্মান হতে না হয়।’

রাজধানীতে ‘নিরাপদ অভিবাসন এবং মানব পাচার প্রতিরোধ’ শীর্ষক সেমিনারে  এভাবেই কথাগুলো বলেন সিরিয়া-ফেরত পটুয়াখালীর ২৮ বছরের শাহীনূর। পরিবারের দারিদ্র্য দূর করতে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দালালরা তাকে নিয়ে যায় সিরিয়ায়। সেখানে তাকে শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়। নিজের সেই দুর্ভোগের কথাগুলো যখন বলছিলেন, ভারী হয়ে আসে পুরো হলরুম। উপস্থিত অনেকেই চোখ মোছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশের একজন নারী বিদেশে গিয়ে নির্যাতিত হবেন, এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। মানব পাচারকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত বলে মনে করেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ। গতকাল দুপুরে সোনারগাঁও হোটেলে এই সেমিনারের আয়োজন করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা) ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। বায়রার সভাপতি বেনজীর আহমেদের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানের শুরুতেই দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানোর নামে দালালদের প্রতারণার শিকার ফরিদপুরের মহিব উল্লাহ তার সীমাহীন দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেন। এরপর সিরিয়া-ফেরত পটুয়াখালীর মেয়েটি এসে তার দুর্ভোগের কথা বলেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে যাবেন, তাদের দক্ষ হয়ে যেতে হবে। সরকার এ জন্য নতুন করে আরও ৪০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করছে। আর প্রবাসীদের কল্যাণেও সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানব পাচারকারীদের দেশের শত্রু উল্লেখ করে তাদের প্রতিরোধে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এই ধরনের খবর আমাদের কষ্ট দেয়। এসব বন্ধে আমাদের কাজ করতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে।’ আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আমি মালদ্বীপে গিয়ে দেখেছি অনেক লোক রাস্তায় শুয়ে আছে। কাজ নেই। দূতাবাস থেকে বলা হয়, এরা বৈধভাবে আসেনি। আরেক দেশে গিয়ে শুনি সেখানকার জেলে আছে আটশ বাংলাদেশি। সাগরপথে হাজার হাজার মানুষ গেছে। থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার জঙ্গলে অনেকের গণকবর মিলেছে। আমরা চাই না এগুলো থাকুক।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এ ধরনের যে কোনো কিছু ঘটলেই মানুষ জিজ্ঞেস করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী করে? সে কারণেই আমাদের কাজ করতে হয়। র‌্যাব এ কারণেই মানব পাচার প্রতিরোধে কাজ করছে। সবাই মিলে সুসংগঠিতভাবে কাজ করতে হবে।’ র‌্যাব ডিজি বেনজীর আহমেদ বলেন, মানব পাচারের সর্বোচ্চ শাস্তি ১২ বছরের জেল। এটি পাচাররোধে যথেষ্ট নয়। মানব পাচাররোধে এর সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত— যাদের মাধ্যমে আমার দেশের ভাই-বোনেরা বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হন, এমনকি অনেকে মৃত্যুর মুখে পতিত হন। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত।

দেশের আইনের দুর্বল দিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। তার ফাঁসির রায় হয়েছে। কিন্তু তাকে আমরা দেশের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নাড়াচাড়া করছি। তার ফাঁসি হয়ে গেলে এ সমস্যাটা হতো না। কিন্তু আইনগত কারণে এটা আটকে আছে। বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তিনি বলেন, মানব পাচারের মতো এমন অমানবিক বিষয় থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে চাই। এর মূল কারণ সচেতনতার অভাব। ব্যাপক জনসচেতনতার মাধ্যমে এ মানব পাচার প্রতিরোধ সম্ভব। ক্ষুদ্র ব্যবসার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, অনেকে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে যান। বেতন ধরা হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু তারা সেখানে গিয়ে কষ্টের মধ্যে পড়েন। বিদেশ গমনেচ্ছু যাত্রীদের বলব, আপনারা সাত লাখ টাকা খরচ না করে দুই লাখ টাকা দিয়ে একটি চায়ের টং দোকান দিলেও মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় হবে। আমাদের দেশের অর্থনীতি বর্তমানে সে পর্যায়ে পৌঁছেছে। যতগুলো মানব পাচারের ঘটনা ঘটেছে তার সবগুলোই ঘটেছে অনিবন্ধিত ভুঁইফোড় এজেন্সির মাধ্যমে। এদের বিষয়ে জনগণকে সচেতন হতে হবে। তিনি আরও বলেন, গত এক বছর ধরে আমাদের গুরুত্বের জায়গা জঙ্গি হলেও মানব পাচার, সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে আগামী এক বছরের মধ্যে সুন্দরবনকে জলদস্যু ও বনদস্যুমুক্ত করা সম্ভব হবে। এ অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব বেগম শামছুন নাহার, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক সেলিম রেজা প্রমুখ। অনুষ্ঠানে পাচার হয়ে ফিরে আসা ১০ জনকে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর